বাবার বাড়িতে ঢুকতে না পেরে রাস্তায় দুই বোন

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানে ১০ কাঠা জমির ওপর তিনতলা বাড়ি। দুই বোনের শৈশবের সব স্মৃতিচিহ্ন সেখানে। ওই বাড়িতেই বেড়ে উঠেছেন তারা। মা-বাবার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কতশত স্মৃতি। তবে বাবার মৃত্যুর পরই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। যে বাড়ির প্রতিটি আঙিনা তাদের চেনা, সেটাই এখন অনেক দূরের। বাবার বাড়িতেই ঢুকতে বাধার মুখে পড়ছেন তারা। হতভাগ্য এ দুই বোন হলেন মুশফিকা মোস্তফা ও মোবাশশারা মোস্তফা। মোবাশশারা দীর্ঘদিন স্বামীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। আর মুশফিকা ঢাকায় তার মায়ের সঙ্গে আলাদা বাসায় থাকেন।

গত ১০ অক্টোবর দুই বোনের বাবা মোস্তফা জগলুল ওয়াহিদের মৃত্যু হয়। সে থেকে দুই বোনকে বাড়িতে ঢুকতে বাধা দিচ্ছেন অনজু কাপুর নামের এক নারী। সর্বশেষ গতকাল শনিবারও তারা সেখানে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন। ওই নারী তাদের বলছেন, ‘এই বাড়িতে তোমাদের কোনো অধিকার নেই। এই বাড়িতে তোমাদের ঢুকতে দেওয়া হবে না। ঢুকতে হলে তোমাদের চাচা ফেরদৌস ওয়াহিদ ও আইনজীবীর অনুমতি লাগবে।’

শুধু তাই নয়, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে অনুজ কাপুর পুলিশ তলব করেন। এরপর গতকাল রাত সাড়ে ৮টার দিকে পুলিশ ওই বাড়ির সামনে যায়। সেখানে গিয়ে পুলিশ দুই বোনকে জানায়, ‘আইনগতভাবে বিষয়টি মীমাংসা করেন। এখন বাড়ির সামনে থেকে চলে যান।’ এরপরও বাবার বাড়ির সামনে অবস্থান করছিলেন দুই বোন।

মুশফিকা মোস্তফা বলেন, প্রথমে তারাই ঘটনার প্রতিকার চেয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু কোনো সহায়তা পাননি। এখন উল্টো পুলিশ পাঠিয়ে তাদের হয়রানির চেষ্টা করা হচ্ছে। এসবের পরও বাবার অধিকারের এক ইঞ্চিও ছাড় দেবেন না বলে জানান তিনি।

মুশফিকা মোস্তফা জানান, তারা দুই বোন। তিনি বড়। তাদের কোনো ভাই নেই। তাদের বাবা মোস্তফা জগলুল ওয়াহিদ বিমানের পাইলট ছিলেন। ২০০৫ সালে অবসরে যান। ওই বছরই মা-বাবার বিচ্ছেদ ঘটে। গুলশান ২ নম্বরে ৯৫ নম্বর রোডের ৪ নম্বর হোল্ডিংয়ে ১০ কাঠা জমির ওপর তিনতলা বাড়ি তাদের। বিচ্ছেদের পর মা গুলশান ২ নম্বরের ১১২ নম্বর রোডের বাসায় ওঠেন। তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকতেন। তবে ছোট বোন মোবাশশারা কখনও বাবার কাছে, কখনও মায়ের কাছে থাকতেন। তিনি বলেন, বাবার বাড়িতে আমারও নিয়মিত যাতায়াত ছিল। রাতে থাকতামও মাঝেমধ্যে। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই। দেশে এখন মায়ের বাসায় উঠেছেন।

মুশফিকা মোস্তফা আরও বলেন, আনুমানিক ছয়-সাত বছর আগে ভারতীয় নাগরিক অনজু কাপুর তাদের বাবার সেবিকা হিসেবে বাসায় ওঠেন। ওই নারী এখন নিজেকে তাদের সৎমা দাবি করছেন। গত ১০ অক্টোবর বাবার মৃত্যু হয়। তারা দুই বোন চেয়েছিলেন, বাবার লাশ বনানী কবরস্থানে দাফন করতে; কিন্তু তাদের ছোট চাচা কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ ও ফুফু আশরাফুন সিদ্দিকী বাধা দেন। চাচা-ফুফুর মতামতের ভিত্তিতে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাদের বাবার লাশ দাফন করা হয়। মৃত্যুর দিন তিনি বাবার বাসাতেই ছিলেন বলে জানান মুশফিকা। কিন্তু বাবাকে দাফনের পরদিন বাবার বাড়িতে ঢুকতে গেলে তাদের বাধা দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ১২ অক্টোবর গুলশান থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেন তিনি।

জিডিতে মুশফিকা উল্লেখ করেন, পৈতৃক বাড়িতে ঢুকতে বাধা দিচ্ছেন অনজু কাপুর। একই সঙ্গে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে তাকে। এরপর ১৪ অক্টোবর তিনি খবর পান, ওই বাড়ি থেকে তার বাবার মূল্যবান জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। এ ঘটনায় ওই দিন তিনি আরও একটি জিডি করেন গুলশান থানায়। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার ছোট বোন মোবাশশারা স্বামীসহ দেশে আসেন । দুই বোন একসঙ্গে কয়েকদিন বাবার বাড়ি ঢুকতে গিয়ে বাধা পান।

মুশফিকা বলেন, আইনজীবী ওয়াজিউল্লাহ তাকে ফোনে বলেন, ‘বাড়ির সামনে ঝামেলা করো না। তোমরা চলে যাও। যেটা পাওয়ার সেটা পরে পাবে।’ গতকাল রাত ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দুই বোন বাবার বাড়ির সামনেই অবস্থান করছিলেন। গুলশান থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ার বিষয়ে।

গুলশান থানার ওসি আবুল হাসান বলেন, এটা জমি-জায়গার বিষয়। পুলিশের কিছু করার নেই। জিডির অনুমতির জন্য আদালতে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। আদালতের অনুমতি পেলে দু’পক্ষকে ডাকা হবে।

মুশফিকা মোস্তফা আরও জানান, এই বাড়ি ছাড়াও ধানমন্ডিতে তার বাবার একটি দোকান রয়েছে। ওই দোকান এবং গুলশানের বাড়িতে একটি ডেন্টাল ক্লিনিক ভাড়া বাবদ মাসে দেড় লাখ টাকা আসে। এ ছাড়া বাবার নামে ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ টাকা রয়েছে। এ সবই অনজু কাপুর আত্মসাৎ করছেন।

এ বিষয়ে কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, ‘আমি কেন তাদের বাবার বাড়িতে ঢুকতে বাধা দেব। এটা তাদের পৈতৃক বাড়ি। তাদের অধিকার। অনজু কাপুর আমার ভাইয়ের দ্বিতীয় স্ত্রী। তিনি বাধা দিলে তারা আইনের আশ্রয় নিক।’ লাশ দাফনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার ভাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ বনানী কবরস্থানে দাফন করা হচ্ছে না। যে কারণে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

Share