‘বেদের মেয়ে জোসনা’র অজানা কথা

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : অর্থ, যশ, খ্যাতি সবকিছুই যেন মোহমায়া। কিছু সময়ের জন্য এটা আমাদের জীবনে ধরা দেয়। আর আমরা দিনরাত মিছে মরিচিকার পিছনে ছুটে চলছি- এটা এক সময়ের সাড়া জাগানো চিত্রনায়িকা অঞ্জু ঘোষের উপলব্ধি। এই অভিনেত্রীর আমন্ত্রণে কলকাতার সল্টলেকে তার বাড়িতে বসে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে তার জীবনের চড়াই-উৎরাই ভালোবাসা-ব্যর্থতা এসব বিষয়ে দীর্ঘ আলাপ করেন। সল্টলেকের মতো বনেদী এলাকার বিরাট এক বাড়ির মালকিন তিনি। বলা চলে রাজকন্যা ও রাজপ্রাসাদ। কিন্তু রাজকন্যার মনে সুখ নেই, আনন্দ নেই, মনের মানুষ নেই।

সংসার জীবনে এই বৈরাগ্য কেন? প্রশ্ন করতেই একরাশ অভিমান নিয়ে কষ্টের কথা শোনালেন অঞ্জু। তিনি বলেন, অঞ্জুর যেন জন্ম হয়েছে অর্থকড়ি, জায়গা জমি সম্পত্তির জন্য। অর্থ জোগান দেয়ার জন্য। আড়াইশ’র মতো সিনেমায় কাজ করেছি, রাত নেই দিন নেই শুটিং আর শুটিং।

আজ এফডিসি তো কাল কক্সবাজার, পরশু ব্যাংকক। ক্লাস নাইনে পড়া একটি কিশোরী অভিনয় অঙ্গনে অভিষেক চাট্টিখানি কথা? চলচ্চিত্রে আসার আগেই বাংলার ঐতিহ্য যাত্রায় আমার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। আমার নামেই ওই সময় বাণিজ্যিক নাটকের টিকিট মুহূর্তের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যেতো। সে যে কি উন্মাদনা আমাকে নিয়ে দর্শকদের মাঝে। অর্থের বিষয়ে ভাগ্যলক্ষ্মী সবসময় আমার প্রতি সদয় ছিল। আমি যখন নাটক করেছি, পরে যখন চলচ্চিত্রে কাজ করেছি অর্থ আমার পিছনে দৌড়াতো। অঞ্জুর পারিবারিক নাম অঞ্জলী। অঞ্জলী থেকে অঞ্জু হওয়ার গল্পটা কেমন ছিল? এ নায়িকা বলেন, ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় আমার বেড়ে ওঠা। পরবর্তীতে চট্টগ্রামে আমাদের পরিবার বসবাস শুরু করে। চট্টগ্রামেই অঞ্জলী থেকে অঞ্জু হওয়ার গল্প শুরু। চট্টলাবাসী আমার অভিনয়কে এত পছন্দ করেছেন, এত ভালোবাসা দিয়েছেন যে, তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আগে তো অফিস পাড়ায় বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো, সেই অনুষ্ঠানে নাটক গুরুত্ব পেতো। আর নাটকে আমাকে পাওয়ার জন্য পরিচালকদের মাঝে হুড়োহুড়ি লেগে যেতো। সবাই চাইতো তাদের নাটকে যেন আমি অভিনয় করি। সোশ্যাল, কমার্শিয়াল যেকোনো নাটকে আমি যেন অপরিহার্য। দর্শনীর বিনিময়ে যে নাটক হতো, শুধু আমার নামেই হাউজফুল হতো।

১৯৮২ সালে অঞ্জুর চলচ্চিত্রে অভিষেক এফ কবীর চৌধুরীর হাত ধরে ‘সওদাগর’ সিনেমায়। প্রথম সিনেমাতেই বাজিমাত। অঞ্জু বলেন, চলচ্চিত্রে আমার অভিষেক রাজকীয়ভাবেই হয়েছিল। সেই সময় বিখ্যাত সিনে পত্রিকা চিত্রালী, পূর্বাণীর প্রথম পাতায় সাংবাদিক শ্রদ্ধেয় আহমেদ জামান খোকা ভাই আমাকে নিয়ে লিড নিউজ করেছিলেন। তার যাদুর লেখনীতে সিনেমা প্রেমীরা আমার প্রতি আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠলেন। প্রতিদিনই নতুন নতুন সিনেমার প্রস্তাব আসতে লাগলো। আমার বয়সও কম তখন। আমার সব বিষয় আমার মা দেখাশুনা করতেন। সত্যি বলতে ‘সওদাগর’-এর পর আমাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।

‘সওদাগর’ যেমন ব্যবসায়িক সফলতা এনে দিয়েছিল, বিপরীতে আমার উপস্থিতি নিয়ে সেই সময় সিনে সমালোচকরা নিন্দার ঝড় বইয়ে দিয়েছিলেন আমার পোশাক ও নাচের মুদ্রায় ‘অশ্লীলতা’ শব্দ জুড়ে দিয়ে। অনেক কষ্ট হতো এসব শুনে। কিন্তু আমার লোকগাঁথা সিনেমাগুলো বাংলাদেশের কৃষ্টি, কালচার, আর ঐতিহ্যকে তুলে ধরতো। আমি মনপ্রাণ জুড়ে অভিনয় করেছি; যেগুলো নিয়ে কেউ লিখতো না। আমার নামের আগেই ‘অশ্লীল’ শব্দটা জুড়ে দিতো। সিনেমায় ‘পলিটিক্স’ বলে একটা কথা রয়েছে। আমাকে তার মধ্যেই ফেলে দেয়া হয়েছিল।

আমার কষ্ট দেখে ভগবান মিট মিট করে হাসছিলেন আর মনে মনে বলছিলেন অঞ্জু ধৈর্য ধর সামনে সুদিন তোর। সত্যিই ১৯৮৯ সালে আমার জীবনে একরাশ আনন্দ বারতা নিয়ে ধরা দিল বাংলাদেশের সর্বকালের সব থেকে ব্যবসা সফল সিনেমা ‘বেদের মেয়ে জোসনা’। ছবিটিতে আমার অভিনয় আজও অমর হয়ে আছে।

দুই বাংলায় হাজার হাজার দর্শক মাসের পর মাস আমার ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ দেখেছেন। দর্শকদের প্রচন্ড চাপে কোলের শিশুর মৃত্যু হয়েছে, এমনও ঘটনা ঘটেছে। বিশ্বখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, নিশ্চয় এমন কিছু রয়েছে না হলে একটানা ৬ মাস সিনেমা হলে প্রদর্শনী চলছে কীভাবে। ভাবা যায়! পশ্চিমবঙ্গে সবসময়ই হিন্দি সিনেমার জয়জয়কার। কিন্তু ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ যখন প্রথম পশ্চিমবঙ্গে রিলিজ হলো, তখন অমিতাভ বচ্চনের ‘হাম’ সিনেমাটিও একসঙ্গে রিলিজ হয়। কিন্তু সিনেমা প্রদর্শকরা ‘হাম’ নামিয়ে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে। সে-কি উন্মাদনা আমাকে ঘিরে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের বধূ-কন্যা-মা-মাসিরা দেবতুল্য সম্মান জানিয়েছেন। আমার অভিনয় জীবন ধন্য- এক জনমে এত শ্রদ্ধা, ভালোবাসা কার ভাগ্যে জোটে। এই সিনেমার জন্য সি.এম.ভি আমাকে ‘গোল্ডেন ডিস্ক’ উপহার দেয়।

সেই সময় কলকাতার বিখ্যাত সব প্রযোজক আমার বাসায় লাইন দিতেন তাদের সিনেমায় সিডিউল দেয়ার জন্য। তাপস পাল, অভিষেক, চিরঞ্জিত, প্রসেনজিৎসহ সেই সময়ের জনপ্রিয় নায়কদের সঙ্গে জুটি বেঁধে অসংখ্য সিনেমায় কাজ করেছি। আমার এই জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে সে সময় কলকাতার অনেক অভিনেত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের অঞ্জু এদেশের সিনেমায় কীভাবে কাজ করে দেখে নেবো।

বাংলাদেশের এত যশ, খ্যাতি জনপ্রিয়তা- সবকিছুকে পায়ে ঠেলে পশ্চিমবঙ্গে চলে গেলেন কেন? এ নায়িকা বলেন, সত্যি বলতে কি আমার সবকিছু আমার মা-বাবাই সিদ্ধান্ত নিতেন। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র পর পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত সব প্রযোজক, পরিচালক আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। তারাও এই সিনেমাটি রিমেক করতে চান।

কলকাতায় যখন এই সিনেমাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় তখন পশ্চিমবঙ্গজুড়ে শুধু অঞ্জু ঘোষ আর অঞ্জু ঘোষ। সেই সময় বিশিষ্ট প্রযোজক-পরিচালকরা আমাকে অনুরোধ করেন কলকাতায় থেকে যেতে। সেই সময় আমি তাদেরকে বলি যে বাংলাদেশেও এই মুহূর্তে আমি ব্যস্ত সময় পার করছি অভিনয়ে। কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। তারা বলে আপনি শুধু হ্যাঁ বলেন। বাকি যা ব্যবস্থা আমরা করবো। অবশ্য ওই সময় কলকাতায় আমার বাবা সল্টলেকের এই বাড়িটা করেছিলেন। আমার এক দিদি আমেরিকায় থাকেন, আমার ভাই ঢাকাতে। বাবা-মা গত হয়েছেন অনেক আগেই। মার মৃত্যুই আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। আমার ছায়াসঙ্গী ছিলেন তিনি।

ঢাকাই সিনেমার নায়ক মাহমুদ কলির সঙ্গে আপনার প্রেমের গুঞ্জন ছিল? অঞ্জু বলেন, এটা সত্যি যে মাহমুদ কলির সঙ্গে আমার মন দেয়া-নেয়া হয়েছিল। একটা সময় যখনই বিয়ের পর্যায়ে সম্পর্কটা গড়ায় তখন তিনি দূরে সরে গেলেন। এই জন্যই কি আজও বিয়ে করে সংসারি হননি? উত্তরে তিনি বলেন, সংসার করার সময় পেলাম কোথায়। কাজ নিয়েই তো পড়েছিলাম। মুম্বইয়ের নায়িকা সুরাইয়ার মতোই জীবন আমার। সিনেমায় আপনার নাচ নিয়ে অশ্লীলতার অভিযোগ রয়েছে? অঞ্জু বলেন, অনেকেই আসল কথাটা জানে না। বাংলাদেশের দু’জন বিখ্যাত নৃত্যপরিচালক আমির হোসেন বাবু, ইলিয়াস জাবেদ উনারা যেভাবে নাচের মুদ্রা দেখাতেন আমি সেভাবেই করতাম। এর বেশি কিছু না।

প্রয়াত চিত্র পরিচালক এফ কবীর চৌধুরীর সঙ্গে আপনার রাতে বিয়ে, পরদিন সকালেই অস্বীকার করেছিলেন কেন? ঝটপট অঞ্জু বললেন, এফ কবীর চৌধুরীর সঙ্গে কোনোদিনই আমার বিয়ে হয়নি বা ভালোবাসা ছিল না। আমি যখন প্রথম ছবি প্রযোজনা করি আমার উপার্জন ঢেলে দেই সেই সিনেমায়। সিনেমাটি যখন রিলিজ দিতে যাবো ঠিক ওই সময়ে উনি আমাকে বললেন, সিনেমাটি উনার প্রডাকশন থেকে রিলিজ করতে হবে। উত্তরে আমি বললাম কেন আপনার প্রডাকশন থেকে রিলিজ করবো? আমি আমার প্রডাকশন থেকে রিলিজ করবো। এই বিষয়টি নিয়ে দু’জনের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেঁধে গিয়েছিল। আমরা যখন সিনেমায় চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করি উনি আমার ওই স্বাক্ষর জাল করে কাবিননামা তৈরি করেছিলেন। যা কিনা মিথ্যা কাবিননামা ছিল।

এত বিশাল বাড়ি। আগের সেই ব্যস্ততা নেই। অফুরন্ত অবসর, আপনার সময় কীভাবে কাটে? এ অভিনেত্রী বলেন, জগতের নিয়মই হলো যার শুরু আছে এর শেষও রয়েছে। আজ যার সাফল্য কাল তার ব্যর্থতা। সাফল্য চিরস্থায়ী নয়। পুরো বাড়িজুড়ে আমার নানা রকমের গাছ রয়েছে। আমি ভীষণ পছন্দ করি। গাছের পরিচর্যা করি। আমার বাড়িতে মন্দির রয়েছে। প্রতিদিন সময় করে পূজা-অর্চনা করি। মাঝে মাঝে সামাজিক অনুষ্ঠান, শপিং করেই আমার সময় চলে যায়। আমাকে নিয়ে কিছু গণমাধ্যমে মিথ্যা বানোয়াট খবর প্রচার করে যা সত্যিই দুঃখজনক। বেনামি কিছু পোর্টাল এসব করে। অঞ্জু বলেন, অনেকেই জানো না এখনো কলকাতায় কোনো ফিল্ম ফেস্টিভাল বা সম্মানিত বিদেশি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কলকাতায় আসলে তাদের যেমন সত্যজিৎ বাবুর সিনেমা দেখানো হয় পাশাপাশি বেদের মেয়ে জোসনাও দেখানো হয়। এর চেয়ে সম্মানের বিষয় আর কি হতে পারে?

বেদের মেয়ে জোসনার সাফল্য ‘তাসখন্দ’ চলচ্চিত্র উৎসবে আমি আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম, সে কি সম্মান আমাকে জানানো হয়েছিল। প্রথম তো আমি যেতেই চাইনি, ভিনদেশি ভাষা কি করবো আমি ওখানে গিয়ে। ওখানে নাকি ঘোড়ার মাংস খায়, আর আমিতো নিরামিষ ভোজি। পিয়াজ, মাছ, মাংস আমি খাই না। সেখানে যাওয়ার আগেই আমার এই বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষকে আগাম জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। ওই উৎসবে আমি গর্জিয়াস পোশাকে গিয়েছিলাম। কিন্তু শালীনভাবে, অশ্লীল পোশাকে নয়। উৎসবে যে কয়টা দিন ছিলাম কোন দিক দিয়ে সাকাল হচ্ছে আর রাত হচ্ছে টেরই পাওয়া যায়নি। এ অভিনেত্রী বলেন, অনেক হয়েছে আর কতো, আর কতো ব্যস্ততা। এখন একটু মানসিক শান্তি চাই। বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক গণমাধ্যমে বিশেষ করে ইউটিউব প্রতিনিয়তই প্রচার করছে, আমি নাকি মুসলমান হয়ে গেছি? আরে সিনেমায় তো আমি অসংখ্যবার কলেমা পড়েছি; তাই বলে কি আমি ধর্ম বদল করেছি। আমি একটি কথা বলতে চাই, ধর্মের চেয়ে সৎ কর্মই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে যেদিন আপনি আমি থাকবো না এই পৃথিবীতে। আপনি তো দেখেছেন আমার বাড়িতে মক্কা শরীফের ছবি, খাজা বাবার ছবি, কোরআন শরীফ শ্রদ্ধার সঙ্গে যেমন রেখেছি তেমনি মা দুর্গার প্রতিমা রয়েছে। মানব ধর্ম বড় ধর্ম।

Share