নয়াবার্তা প্রতিবেদক : ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী মূদ্রমানে ১ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকায় ক্রয় করা ২৬০টি সম্পত্তি রয়েছে। এসবের জন্য তিনি পরিশোধ করেছেন অন্তত ১৩৪ দশমিক ৭৬ মিলিয়ন পাউন্ড। যুক্তরাজ্য সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত কোম্পানি ফাইলিংয়ের তথ্য থেকে এ হিসাব জানা গেছে। আওয়ামী লীগের তিনবারের সংসদ সদস্য (এমপি) জাভেদ যুক্তরাজ্যের সম্পদের বিপরীতে আরও অন্তত ৫৩৭টি মর্টগেজ রেখেছেন। সম্পদগুলোর বেশিরভাগই লন্ডনে। তবে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) দেওয়া হলফনামার সঙ্গে তিনি যে আয়কর রিটার্ন দিয়েছেন, সেখানে বলা হয়েছে তার কোনো বৈদেশিক আয় নেই।
হলফনামায় বলা হয়েছে, ব্যবসা থেকে তার বার্ষিক আয় মাত্র ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। হলফনামায় স্ত্রী ও সন্তানের মতো নির্ভরশীলদের বার্ষিক আয় প্রকাশের নিয়ম থাকলেও মন্ত্রী তা প্রকাশ করেননি। এতে আরও বলা হয়েছে, জাভেদ ও তার স্ত্রীর যৌথভাবে মাত্র ১৭ কোটি ৯০ লাখ টাকার শেয়ার ও ডিবেঞ্চার রয়েছে, যা যুক্তরাজ্যে তার যে মোট বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে, এর তুলনায় প্রায় ১০০ গুণ কম।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চতুর্থবারের মতো চট্টগ্রাম-১৩ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ভূমিমন্ত্রী জাভেদ। যুক্তরাজ্যে তার যে সম্পত্তি রয়েছে, সেগুলো অন্তত আটটি কোম্পানির কেনা। এসব কোম্পানির প্রতিটিতেই ভূমিমন্ত্রীর উল্লেখযোগ্য অংশীদারত্ব রয়েছে। কোম্পানিগুলো হলো—আরামিট প্রপার্টিজ, রুখমিলা প্রপার্টিজ, সাদাকাত প্রপার্টিজ, নিউ ভেঞ্চারস (লন্ডন) লিমিটেড, জিটিএস প্রপার্টিজ, জেবা প্রপার্টিজ, জিটিজি প্রপার্টি ভেঞ্চারস লিমিটেড ও জারিয়া প্রপার্টিজ। এসব কোম্পানি ২০১০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো নিউ ভেঞ্চারস (লন্ডন) লিমিটেড। এটি ২০১০ সালের ১৩ জুলাই প্রতিষ্ঠিত৷ কোম্পানির নথি অনুযায়ী, ভূমিমন্ত্রী জাভেদ বর্তমানে এটির একমাত্র পরিচালক। ২০২১ সালের জুলাই থেকে তিনি এ দায়িত্বে আছেন। জিটিএস প্রপার্টিজ লিমিটেড ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই প্রতিষ্ঠানটিরও একমাত্র পরিচালক ভূমিমন্ত্রী জাভেদ। তিনি রুখমিলা প্রপার্টিজের ৬০ শতাংশ শেয়ারের মালিক, যেটি ২০১৯ সালের ৬ জুলাই প্রতিষ্ঠিত। এর বাকি অংশের মালিক তার স্ত্রী রুখমিলা জামান। ২০২০ সালের ৬ মে প্রতিষ্ঠিত আরামিট প্রপার্টিজ, ২০২০ সালের ৩০ জুলাই প্রতিষ্ঠিত জিটিজি প্রপার্টি ভেঞ্চারস লিমিটেড ও ২০২১ সালের ২২ জুলাই প্রতিষ্ঠিত সাদাকাত প্রপার্টিজ লিমিটেডের একমাত্র পরিচালকও জাভেদ। একইসঙ্গে তিনি ২০২১ সালের ২১ জুন প্রতিষ্ঠিত জেবা প্রপার্টিজ লিমিটেড ও একই দিনে প্রতিষ্ঠিত জারিয়া প্রপার্টিজ লিমিটেডেরও একমাত্র পরিচালক।
এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্পদ রয়েছে জিটিএস প্রপার্টিজ লিমিটেডের, যার মূল্য ৭৩ দশমিক ১৫ মিলিয়ন পাউন্ড বা ১ হাজার ২৫ কোটি টাকার সমান। গত বছর এই কোম্পানির সম্পদ প্রায় তিন দশমিক ০৩ মিলিয়ন পাউন্ড বেড়েছে এবং ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ব্যাংক আমানত রয়েছে। একইসঙ্গে যুক্তরাজ্য সরকারের ওয়েবসাইটে সর্বজনীনভাবে তালিকাভুক্ত ২৬০টি সম্পত্তির মধ্যে ১৭৯টির মালিক জিটিএস প্রপার্টিজ লিমিটেড, যার বেশিরভাগই ফ্ল্যাট ও বাড়ি।
২০২২ অর্থবছরের শেষে দাখিল করা আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, এই আট কোম্পানির ২ হাজার ৪২৩ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। সব মিলিয়ে এসব কোম্পানির ৩৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা রয়েছে।
ভূমিমন্ত্রীর ২৬০টি সম্পত্তির মধ্যে ১৫৫টি লন্ডনে ও ৩০টি লিভারপুলে। বাকিগুলো স্লফ, সালফোর্ড, গিলিংহাম, ব্রমলি, ক্যাম্বারলে, শেফিল্ড, ম্যানচেস্টার, লিডস, ওয়েম্বলি, টুনব্রিজ ওয়েলস, ডার্টফোর্ড, অক্সব্রিজ, স্টিভেনজ, সেভেনোয়াকস, রমফোর্ড, আইলিংটন, চেমসফোর্ড, বার্মিংহাম, আপমিনিস্টার, রিডিং, হ্যারো, ফ্লিট ও বারনেটে।
তার সবচেয়ে দামি সম্পত্তি লন্ডনের ক্লিভল্যান্ড স্ট্রিটে ঐতিহাসিক এমারসন বেইনব্রিজ হাউস, যার জন্য তিনি ১২ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন পাউন্ড বা ১৭৭ কোটি ১০ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। তিনি এটি ২০২১ সালের ১৬ জুলাই কিনেছিলেন। এটি একটি ফ্রিহোল্ড সম্পত্তি, যার অর্থ তিনি কেবল বাড়ি নয়, জমিরও মালিক।
বিভিন্ন ঋণদাতা ও রুখমিলা প্রপার্টিজ লিমিটেডের মধ্যে যেসব মর্টগেজ চুক্তি হয়েছে, এর অধিকাংশেই উৎপল নামে একজনের সই রয়েছে। তার ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে ‘৫৩ কালুরঘাট হেভি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট, চট্টগ্রাম’। আরামিট গ্রুপ লিমিটেডের করপোরেট অফিসের ঠিকানাও এটি। ইন্টারনেটে সার্চ করে উৎপল পালের একটি লিংকডইন প্রোফাইল পাওয়া যায়। সেখানে উৎপল পাল নিজেকে আরামিট গ্রুপের সহকারী মহাব্যবস্থাপক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ওই প্রোফাইলে তার যে ছবি দেওয়া আছে, সেটির সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপের প্রোফাইল ছবির মিল পাওয়া গেছে। কিন্তু ওই নম্বরে যোগাযোগ করা হলে অপর পাশ থেকে একজন জানান, তিনি উৎপল নন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘বাংলাদেশিরা দুটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদেশে সম্পদ অর্জন করতে পারেন। একটি হলো বিদেশে ব্যবসা বা চাকরির মাধ্যমে এবং অন্যটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশ থেকে তহবিল পাঠানোর মাধ্যমে।’ তিনি বলেন, ‘কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি কীভাবে বিদেশে সম্পদ অর্জন করেছেন, তা না জেনে মন্তব্য করা সম্ভব না। বিদেশে কার সম্পদ আছে, তা খুঁজে বের করা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ নয়। এটা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাজ। দুটি পৃথক সংস্থা। এ ব্যাপারে বিএফআইইউ কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি না তিনি জানি না’, বলে জানান। ভূমিমন্ত্রী জাভেদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো অনুমোদন নিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ভূমিমন্ত্রী জাভেদ বিদেশে টাকা পাঠাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে কোনো অনুমোদন নেননি। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বিএফআইইউ প্রধান মোঃ মাসুদ বিশ্বাস।
গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একজন মন্ত্রীর বিদেশে ২০৩ বিলিয়ন টাকার ব্যবসার বিষয়টি প্রথমবারের মতো সামনে আনে। যদিও টিআইবি কোনো মন্ত্রীর নাম প্রকাশ করেনি, তবে তারা বলেছে, কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ যদি তথ্য চায়, তাহলে তারা এর প্রমাণ দেবে।
সেদিন সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি জানায়, একজন মন্ত্রী ও তার স্ত্রী সক্রিয়ভাবে বিদেশে ছয়টি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি পরিচালনা করেন, যার মূল্য ১৬৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন পাউন্ড।
নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় আওয়ামী লীগের ওই প্রার্থী বিদেশে তার বিনিয়োগের কথা উল্লেখ করেননি বলেও জানায় টিআইবি। টিআইবির ঘোষণার পরপরই এ মন্ত্রীর ব্যাপারে জনমনে কৌতূহল দেখা দেয়।
আইন অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব প্রার্থীকে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামার মাধ্যমে আটটি ব্যক্তিগত ও আর্থিক তথ্যের সপক্ষে কাগজপত্র দাখিল করতে হবে। তবে প্রার্থীদের দেওয়া হলফনামার তথ্য কখনোই যাচাই-বাছাইয়ের উদ্যোগ নেয়নি ইসি।
আইন অনুযায়ী, হলফনামায় ভুল বা মিথ্যা তথ্যের প্রমাণ পেলে প্রার্থিতা বাতিল হতে পারে। এ ছাড়া ফৌজদারি আইনে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডও হতে পারে।
মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্যিক গ্রুপ আরামিট গ্রুপের চেয়ারপারসন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি নর্থ ওয়েস্ট সিকিউরিটিজ লিমিটেড ও নর্থ ওয়েস্ট শিপিং লাইনস লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।