রাইসির জয়ে ইরান আরও বেশি রক্ষণশীল হয়ে উঠতে পারে

নিজস্ব ডেস্ক প্রতিবেদক : নির্বাচনের ‘হৃদয়’ হচ্ছে প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা না থাকলে নির্বাচন হয়ে পড়ে কঙ্কালের মতো। গত মাসেই ইরানের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এ কথা বলেছিলেন। ইরানের অনেক ভোটারের কাছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কোনো আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি।

দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রোববার জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে কট্টরপন্থী বলে পরিচিত ইব্রাহিম রাইসিকেই। ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট তাঁদের অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইরানের এবারের নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক ছিল না। একেবারে ইরানের নির্বাচনের মানের দিক বিবেচনা করলেও নির্বাচন প্রকৃত নির্বাচনের মতো হয়নি।

আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারের নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। ৬১ দশমিক ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন ইব্রাহিম রাইসি। তিনি ভোট পেয়েছেন ২ কোটি ৮৯ লাখ ৩৩ হাজার ৪। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর দেশটিতে সবচেয়ে কম ভোটদানের ঘটনা ঘটেছে এবার।

রাইসিকে আমেরিকা কীভাবে গ্রহণ করে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ইরানে করোনাভাইরাস মহামারি ব্যাপক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। দেশটির অর্থনীতি ধুঁকছে। তবে এর জন্য মহামারির পাশাপাশি ঘুষ, দুনীর্তি, অব্যবস্থাপনা ও সর্বোপরি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞাও দায়ী।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে ৬০০ জনের বেশি প্রার্থী নিবন্ধন করেছিলেন। কিন্তু দেশটির গার্ডিয়ান কাউন্সিল সাতজন বাদে সবাইকে অযোগ্য ঘোষণা করেন। এই অযোগ্যদের মধ্যে ছিলেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট, বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট ও দেশটির পার্লামেন্টের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ স্পিকার পর্যন্ত। দেশটির এই গার্ডিয়ান কাউন্সিল মূলত ধর্মীয় নেতা ও আইনজীবীদের একটি দল যাঁরা প্রার্থীদের যাচাই করেন।

এই গার্ডিয়ান কাউন্সিলই এবার রাইসির পথ পরিষ্কার করে রেখেছিলেন। রাইসি মূলত দেশটিতে কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা ও বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে পরিচিত। তবে তাঁর চেয়েও বড় কথা হচ্ছে তিনি দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির ঘনিষ্ঠজন।

১৯ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৯০ শতাংশ ভোট গণনা শেষ হতে না হতেই তাই নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পরাজয় মেনে নেন। নির্বাচনে আরেক কট্টরপন্থী ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডসের সাবেক প্রধান মোহসিন রেজাই ১২ শতাংশ ভোট পান। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আবদেল নাসের হেমাতি পান ৮ শতাংশ ভোট। তবে এবারের নির্বাচনে ভোট দেননি অনেক উদারপন্থী ও মধ্যপন্থী ইরানিরা।

রাইসি তাঁর নির্বাচনী প্রচারে রক্ষণশীল ভোটারদের কাছে দুর্নীতি দূর করার প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁর এই প্রচার কাজে এসেছে। দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খামেনির মতো তিনি পশ্চিমাদের সঙ্গে গভীর সম্পর্কের বিরোধী।

দুই বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তাঁর বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে আরেকটি পাতানো নির্বাচনের সময় গণতন্ত্রপন্থী সবুজ আন্দোলন দমন-অভিযানে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৮৮ সালে তেহরানের ডেপুটি প্রসিকিউটর জেনারেল থাকার সময় ডেথ কমিশনের সদস্য হিসেবে হাজারো রাজবন্দীর বিচারবর্হিভূত মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ আনে।

রাইসিকে আমেরিকা কীভাবে গ্রহণ করে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ইরানে করোনাভাইরাস মহামারি ব্যাপক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। দেশটির অর্থনীতি ধুঁকছে। তবে এর জন্য মহামারির পাশাপাশি ঘুষ, দুনীর্তি, অব্যবস্থাপনা ও সর্বোপরি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞাও দায়ী। এখন অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় বিশ্বশক্তিগুলোর সঙ্গে তেহরানের পারমাণবিক আলোচনা শুরু হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ইরানের সঙ্গে ছয় বিশ্বশক্তির পারমাণবিক চুক্তিটি আবারও আলোর মুখ দেখার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে তেহরানের ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সম্ভাবনাও উঁকি দিচ্ছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফা এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে ২০১৮ সালে প্রত্যাহার করে নেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আবার ওই চুক্তিতে ফিরবেন বলে বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কেউ কেউ রাইসির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ওই চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। ইরানের নতুন প্রেসিডেন্টের পরামর্শকেরা নতুন কোনো মতাদর্শ যুক্ত করতে পারে যাতে ওই আলোচনা আরও কঠিন হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত খামেনির পক্ষ থেকে ভিয়েনার আলোচনায় সমর্থন দেওয়া হয়েছে।

ইরানের চূড়ান্ত প্রেসিডেন্ট বিতর্কে রাইসি নিজেও বলেছেন, তিনি ইরানকে ওই চুক্তিতে ফেরাতে আলোচনার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।

ইকোনোমিস্ট তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ইরানের সর্বোচ্চ ধমীয় নেতা খামেনির ধর্মীয় উপদেষ্টা দলের কৌশল অস্পষ্ট ও অননুমেয়। কারও কারও ধারণা, খামেনি নিজের উত্তরসূরি হিসেবে রাইসিকে গড়ে তুলছেন।
রাইসির শাসনামলের ইতিবাচক দিক হতে পারে ওই চুক্তি থেকে অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো অর্জন করার বিষয়টি। এ ছাড়া দেশটিতে করোনার টিকাদান কর্মসূচি চালু করাটাও ইতিবাচক দিক হতে পারে।

প্রেসিডেন্ট রুহানির দুই মেয়াদের নেতৃত্বে সংস্কারবাদী ও মধ্যপন্থীরা গণতন্ত্রের পথে কিছুটা এগোলেও ধর্মীয় নেতৃত্ব ও তাঁদের মিত্র নিরাপত্তা বাহিনী ক্ষমতা আরও পোক্ত করেছে। গত বছরে পার্লামেন্ট নির্বাচনে সংস্কারবাদী বেশিরভাগ প্রার্থীকেই অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।

এ বছর ফাঁস হওয়া এক তথ্যে দেখা গেছে, রুহানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বর্ণনা করেছেন, তাঁকে প্রায়ই দেশটির ক্ষমতাশালী সংস্থা ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডস পাশে সরিয়ে রাখে।

আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনির উত্তরসূরি হিসেবে রাইসিকে ভাবছেন কেউ কেউ। থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক আলী ভায়েজ মনে করেন, খামেনি ইরানকে দেশটির প্রেসিডেন্টশাসিত পদ্ধতি থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে নিতে পারেন বা সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার ভূমিকা কোনো কাউন্সিলের হাতে দিতে পারেন। তিনি বলেন, ‘পার্লামেন্ট সিস্টেম চালু করা হলে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ও প্রেসিডেন্টের অফিসের মধ্যে বাদানুবাদের আশঙ্কা কমবে। এ ছাড়া সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার পদ বিলুপ্ত করা হলে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সন্তান (মোজতাবা) পেছনে থেকে প্রভাব রাখতে পারবেন।’

ইকোনোমিস্ট তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ইরানের সর্বোচ্চ ধমীয় নেতা খামেনির ধর্মীয় উপদেষ্টা দলের কৌশল অস্পষ্ট ও অননুমেয়। কারও কারও ধারণা, খামেনি নিজের উত্তরসূরি হিসেবে রাইসিকে গড়ে তুলছেন। কিন্তু উত্তরসুরি হওয়ার তালিকায় তাঁর ছেলে মোজতাবা ছাড়াও আরও অনেকে আছেন। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, ইরানের অনির্বাচিত কিছু তাত্ত্বিক ও রেভল্যুশনারি গার্ডসকে ভোটারদের নির্বাচিত সংস্কারপন্থী, মধ্যপন্থী ও সনাতনপন্থীরা চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যাবেন। আর এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ছয় জাতির পারমাণবিক চুক্তি পুর্নবহাল হলেও পশ্চিমা প্রভাবে ইরানে অস্থিতিশীলতা থাকবে। নির্বাচনে রাইসির জয় দেশটির উদারীকরণের পথে বড় বাধা হয়ে আসতে পারে। আর ইরান আরও বেশি রক্ষণশীল হয়ে উঠতে পারে।

Share