রাজধানীতে টোলের নামে চাঁদাবাজি,লাগাম টানবে কে

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : রাজধানীতে টোলের নামে চলছে অবাধ চাঁদাবাজি। কিন্তু এই চাঁদাবাজির লাগাম টানার যেন কেউ নেই। লাল, হলুদ কিংবা নীল পোশাক পড়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) নামে চাঁদাবাজির এই মহোৎসব চলছে। শুধু মোটরসাইকেল কিংবা ট্রাক নয়, সবাইকেই গুনতে হচ্ছে টাকা। রক্ষা পাচ্ছেন না ভ্যান চালকরাও। ধরিয়ে দিচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের রশিদ। সিটি টোলের দোহাই দিয়ে দিন-রাত রাজধানীর প্রায় সব এলকায় চলছে চাঁদাবাজি। প্রতিদিন কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে এই চক্রের বিরুদ্ধে। আর নিরব ভুমিকায় রয়েছেন সিটি করপোরেশন।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর গুলিস্তানে স্টেডিয়াম মার্কেটে প্রবেশ পথে ভ্যানগাড়ি ঢুকতেই লাঠি হাতে লাল পোশাকধারী তিন যুবকের থামিয়ে দেয়। জিজ্ঞেস করতেই সাফ জানিয়ে দেয়, সিটি টোল দিতে হবে।

ভ্যান চালক মোতালেব বলেন, ভাড়া পাবো কত? তার মধ্যে আবার টোল! এভাবে জুলুম করলে কিভাবে হবে। করোনায় খুব একটা ট্রিপ নাই। তার মধ্যে টোল দেওয়া কষ্ট কর। এ নিয়ে কথার কাটাকাটি হয়। এক পর্যায় লাল পোশাকধারীরা ভ্যানচালককে মারধর করেন। শেষ পর্যন্ত টোল না দিয়ে প্রবেশ করতে পারলেন না ভ্যানচালক।নচালক।

বৈধ ও অবৈধ স্পট কতগুলো: রাজধানীর গুলিস্তান, ফুলবাড়ীয়া ও সায়েদাবাদে ইজারাদারদের মাধ্যমে বৈধভাবেই আদায় করা হয় সিটি টোল। এ ছাড়া গুলিস্তান স্টেডিয়াম মার্কেট, মানিকনগর, সদরঘাট বাংলাবাজার মোড়, নিউ মার্কেট, নীলক্ষেতসহ অন্তত ২০টি স্পটে চলে অবৈধ চাঁদাবাজি। সড়কে গাড়ি নামলে চাঁদা গুনতে হয় চালক কিংবা মালিকদের। ডিএসসিসির কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই দিনের পর দিন অবৈধ স্পটগুলো দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন প্রভাবশালী একটি চক্র। রোজার শেষের দিকে চাঁদাবাজির পাশাপাশি সড়ক থেকে ঈদ বকশিশ তুলতেও দেখা গেছে।

যেভাবে তোলা হয় চাঁদা : দিনের বেলাতো বটেই, রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই চক্রের তৎপরতা আরো বাড়ে। প্রতিটি সদস্যের হাতে থাকে লাঠি, গাড়ি দেখলে লাঠি দিয়ে সিগ্যানাল দেওয়া হয়। রমজানের শেষের দিকে গভীর রাতে নন্দীপাড়া ব্রিজে দেখা দেখা গেছে, ট্রাক-কাভার্ডভ্যান, মালবাহী গাড়ি থেকে ঈদ বকশিশ তোলা হচ্ছে। সেখানে লাল পোশাক পরে সিটি কর্পোরেশনের রশিদ দিয়ে চাঁদা আদায় করছে তারা। এই চিত্র শুধু নন্দীপাড়ায়ই নয়, মতিঝিল, কমলাপুর, জুরাইন, কদমতলী, পোস্তগোলা, শনির আখড়া, রায়েরবাগ, কোনাপাড়া, ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার, মাতুয়াইল, মেরাদিয়া, মাদারটেক, যাত্রাবাড়ী গিয়ে দেখা গেছে এই চিত্র। এ সব এলাকায় বাস, মিনিবাস, সিএনজি, টেম্পু, পিকআপ, ট্রাক, ব্যক্তিগত গাড়ি, মাইক্রোবাস থেকেও নিয়মিত চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবহন বিভাগের বক্তব্য : ‘উত্তরা চাকা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ডিএসসিসির কাছ থেকে গত বছরের নভেম্বর মাসে সায়েদাবাদ স্টপওভার বাস টার্মিনাল ইজারা নিয়েছে। ইজারা মূল্য ২ কোটি ৯৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩৩৩ টাকা।

সিটি করপোরেশনের শর্তে ছিলো, টার্মিনাল থেকে বের হওয়া বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত যানবাহন থেকে টোল আদায় করা যাবে। ডিএসসিসির শর্ত না মেনেই নির্ধারিত এলাকার বাইরেও সাব-ইজারার দিয়েছেন উত্তরা চাকা নামের প্রতিষ্ঠানটি। যা নিয়ম বহির্ভূত। তারা ট্রাক থেকে শুরু করে সব ধরনের যানবাহন থেকেই টোল আদায়ের নামে চাঁদাবাজি করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যারা সাব-ইজারা দিচ্ছেন, তারা জামানতের নামেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

যানবাহন চালকদের যত অভিযোগ: রাস্তায় গাড়ি নামলেই চাঁদা গুনতে হয়। প্রতিটি মোড়ে মোড়ে চাঁদাবাজরা দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের টাকা না দিলে গাড়ি ছাড়া যায় না। ঢাকা দক্ষিণ সিটির মূল সড়কসহ সব অলিগলিতেই এখন তারা সক্রিয়। পুলিশের সামনে তারা সিটি করপোরেশনের রশিদ দিয়ে টাকা আদায় করছে। আবার ঈদ বকশিসও দিতে হয়েছে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ চালকরা। তাদের লাগাম টানবে কে? যাত্রাবাড়ী এলাকায় ট্রাক চালক রুহুল আমিন বলেন, চাঁদার কথা বলে আর লাভ কি? মহাখালি থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত ৫ স্পটে ৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। এভাবে প্রতিটি স্পটে চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়া তাদের ঈদ বকশিশও দিতে হয়েছে। তবে ঈদ বকশিশের জন্য কোনো রশিদ দেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট বিভাগের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ উঠেছে। তাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে গেলেও কোনো কর্ণপাত করেন না। চাঁদাবাজি বন্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন না তারা।

ডিএসসিসির মহাব্যবস্থাপক (পরিবহন) বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, এ ধরনের অভিযোগ এখনো পাইনি। আপনি জানালেন, খোঁজ নিয়ে দেখবো কারা এর সঙ্গে জড়িত। অভিযুক্ত কাউকে ছাড় দেবো না। কেউ যদি নিয়ম ভেঙে সাব-ইজারা দেয়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা খুব শিগরই মোবাইল কোর্ট বসাবো। তিনি আরো বলেন, আমরা কয়েকবার ওসি-ডিসিকে চিঠি দিয়েছি। যাতে করে ইজারাদারের বাইরে অন্য স্পটে অবৈধ ভাবে টোল আদায় না করে। ট্রাক থেকে টোল নেয়া সম্পর্নরূপে নিষেধ রয়েছে।

উত্তরা চাকার স্বত্ত্বাধিকারী জাকিয়া সুলতানা বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য নয়। আমরা চাঁদাবাজি করি না। নিয়ম মেনেই টোল আদায় করা হয় এবং সবাইকে রশিদ দেওয়া হয়। দনিয়া, শনির আখড়া ও রায়েরবাগ এলাকায় দেখা যায়, ওই এলাকায় যে সব রশিদ ব্যবহার হয় তাতে উত্তরা চাকা’র জাকিয়া সুলতানার নাম রয়েছে। সেখানে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, লেগুনা, সিএনজি, পিকআপ, ট্রাক থেকে টোল আদায় করছে। তবে ইজারায় উল্লেখ্য রয়েছে সায়েদাবাদ স্টপওভার বাস টার্মিনাল। শনির আখড়ায় বর্ণমালা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনেও চালকদের হাতে রশিদ ধরিয়ে নিচ্ছেন আরেকটা গ্রুপ। তবে তারা বলছে, উত্তরা চাকার স্বত্ত্বাধিকারী জাকিয়া সুলতানার কাছে থেকে সাব-ইজারা নিয়েছি। ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায়ও একই রশিদ দিয়ে টোলের নামে চাঁদা আদায় করছেন আরেকটি পক্ষ। এই সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে শুরু করে সব ধরনের গাড়ি থেকে টোল আদায় করতে দেখা গেছে।

পুলিশ সদর দফতরের এআইজি মিডিয়া বলেন, সড়কে পণ্যবাহী যানবাহনে হয়রানি-চাঁদাবাজি বন্ধের কঠোর নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। এছাড়া যেকোনো প্রকার চাঁদাবাজি বন্ধেও কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। এ ধরনের চাঁদাবাজির অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ডিএসসিসির ৪৬ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র মো. শহিদ বলেন, ঢাকা সিটিতে এ ধরনের অবৈধ টোলের নামে চাঁদাবাজির বিষয়ে পুলিশকে চিঠি দিয়ে বলা আছে, অভিযোগ পেলেই চাঁদাবাজদের আটক করার জন্য। কিন্তু পুলিশ নিরব। তাই আলাপ-আলোচনা করে মোবাইল কোর্ট পাঠানো হবে।

নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, ঢাকা সিটিতে যে সব টোল আদায় করা হচ্ছে, তা পুরোপুরি অবৈধ। নীতি-নৈতিকতার কোনো ভিত্তি নেই। ক্ষমতার জোরে একটি চক্র এ কাজ করছে। এটা পুরোপুরি চাঁদাবাজির মধ্যে পরে।

Share