রোহিঙ্গারা নাগরিক অধিকারসহ নিরাপত্তা পেলেই ফিরবেন

টেকনাফ প্রতিনিধি : রোহিঙ্গা হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ নাগরিক অধিকার, নিরাপত্তা, জায়গা-জমি ও বাড়িঘর নির্মাণের স্বীকৃতি দিলেই মিয়ানমারে ফিরবে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। আজ বুধবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে টেকনাফ স্থলবন্দর এলাকার ভবনে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের কাছে রোহিঙ্গারা এ কথা বলেছেন।

প্রথম দিনে একশ রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেছেন মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। এ সময় শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধিসহ সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে সকাল সোয়া ১০টার দিকে স্পিডবোটে করে মিয়ানমারের পাঁচ নিরাপত্তাকর্মী ও টেকনিক্যাল টিমের ১৭ সদস্য মিলে ২২ জনের প্রতিনিধি দল টেকনাফ-মিয়ানমার ট্রানজিট জেটি ঘাটে পৌঁছায়। বৈঠক শুরু হলে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আসা পাঁচ নিরাপত্তাকর্মী মিয়ানমার ফিরে গেছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নিজ দেশ মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে মানবিক আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আর শুরু হয়নি। তবে ২০১৯ সালে দুদফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে তখন ফিরতে রাজি হননি রোহিঙ্গারা।

এরপরও আশ্রিতদের ফেরত পাঠাতে প্রচেষ্টা থেমে রাখেনি বাংলাদেশ সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলতে বুধবার কক্সবাজারের টেকনাফে আসে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল। প্রত্যাবাসনে তালিকাভুক্ত পরিবারের বাদ পড়া রোহিঙ্গাদের বিষয়ে যাচাই-বাছাই শুরু করেছে প্রতিনিধি দল।

জানা যায়, টেকনাফ স্থলবন্দরের অভ্যন্তরে মালঞ্চ সম্মেলন কক্ষে রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাই-বাচাই কাজ শুরু হয়। মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের মংডুর আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে রয়েছেন কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) অতিরিক্ত কমিশনার মুহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণ চলছিল।

সূত্র জানায়, মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটি টেকনাফে অবস্থানকালে প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত ৪২৯ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাই করছে। একই সঙ্গে আলাপ করা হচ্ছে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে সম্প্রতি জন্ম নেওয়া শিশুদের তথ্যও নথিভুক্ত করার বিষয়ে।

এর আগে প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ ৮ লাখ ৬২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারের কাছে পাঠিয়েছিল। ওই তালিকা থেকে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রাথমিকভাবে এক হাজার ১৪০ জনকে বাছাই করে মিয়ানমার। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের সম্মতি মিললেও বাকি ৪২৯ জনের ব্যাপারে তাদের আপত্তি ছিল। তাদের তথ্য যাচাইয়ের জন্যই এসেছে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল। সবার তথ্য যাচাই-বাছাই শেষ করতে অন্তত ৫-৬ দিন সময় লাগতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ‘টেকনাফের লেদা-নয়াপাড়া ক্যাম্পে অবস্থান করা ২০ থেকে ২৫টি পরিবারের ৫০ থেকে ৬০ জন রোহিঙ্গাকে ধাপে ধাপে টেকনাফ স্থলবন্দরের ভেতরে রেস্ট হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের ক্রমান্বয়ে নেওয়া হয় প্রতিনিধিদের সামনে। সাক্ষাৎকার দিয়ে ফেরা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। মিয়ানমার প্রতিনিধি দল তাদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছে, তারা নিজ দেশে (মিয়ানমার) ফিরতে চান কিনা। জবাবে রোহিঙ্গারা বলেছেন, মর্যাদাপূর্ণ নাগরিক অধিকার, নিরাপত্তা, জায়গা-জমি ও রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেই তারা মিয়ানমারে ফিরবেন।’

তিনি জানান, আগে মিয়ানমার অবস্থানের কোনো প্রমাণ রয়েছে কিনা, প্রতিনিধি দল এমনটি জানতে চাইলে- রোহিঙ্গারা জানান মিয়ানমানের সীলযুক্ত কাগজপত্র রয়েছে তাদের কাছে।

এদিকে, বৈশ্বিক চাপে আবারও সম্প্রতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে উদ্যোগী হওয়ায় মিয়ানমারের পাইলট প্রকল্পের আওতায় এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি সামনে আসে। তবে এর আগে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়িত করার তিন মাসের মাথায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি সই হলেও গত প্রায় ছয় বছরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

এ ছাড়া ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বেঁধে দেওয়া সময়ে এক দফা প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরে চীনের মধ্যস্থতায় ২০১৯ সালে আবার প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। এরপর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক বাহিনী। এ ঘটনার পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আলোর মুখ দেখেনি।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার থেকে পাঠানো রোহিঙ্গাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করতে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলতে ছয় দিনের সফরে এসেছে। প্রথম দিনে তালিকাভুক্ত একশ রোহিঙ্গার সঙ্গে প্রতিনিধি দল কথা বলেছে। ক্রমান্বয়ে বাকি দিনগুলোতে অন্যদের সঙ্গেও কথা বলবেন তারা। এ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা প্রত্যাবাসন নিয়ে কোনো কিছুই বলবেন না। তারা শুধুই রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নেবেন।

তিনি আরও বলেন, মূলত ২০১৮ সালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে ৮ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দেওয়া হয়। এরপর মিয়ানমার ৬৮ হাজার রোহিঙ্গার ফিরতি তালিকা পাঠায়। সেখানে অনেক পরিবারের সদস্য বাদ পড়ে। বিষয়টি তাদের (মিয়ানমারকে) জানানো হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে তথ্য যাচাই-বাছাই করতে তারা (মিয়ানমার) আগ্রহ প্রকাশ করে। বাদপড়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তারা কথা বলছেন, কেন বাদ পড়েছেন এবং তাদের দলিলপত্র দেখছেন।

Share