সাক্ষীদের তাহলে মারল কারা?

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : প্রকাশ্য বাজারে জনসন্মুখে এক ব্যক্তিকে হত্যার পর ঐ ব্যক্তির ছেলেকে অন্য একটি মামলায় ফাঁসিয়ে কারাগারে ঢুকিয়েছিলেন । উদ্দেশ্য হত্যা মামলা থেকে নিজেকে রক্ষা করা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ওই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন তিনি। এরপর আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খোলেন চারজন। দুই মাস কারাবাসের পর তিনি যেদিন জামিনে মুক্তি পান, সেদিনই ওই সাক্ষীদের দুজন খুন হয়েছিলেন। এর কিছু দিন পর মাইক্রোবাস চাপায় মারা গিয়েছিলেন তিনি। তবে এখন পুলিশ বলছে, সেটি দুর্ঘটনা ছিল না। পরিকল্পিতভাবে তাঁকে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।

এই ব্যক্তির নাম শাহান শাহ আলম ওরফে বিপ্লব (৩৪)। তিনি ছিলেন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার লোচনপুরের বাসিন্দা। এলাকায় কেব্‌ল সংযোগের ব্যবসা করতেন। তাঁর বিরুদ্ধে চারটি হত্যাসহ ১০টি মামলা হয়েছিল।

২০২১ সালের ১২ আগস্ট রাত পৌনে আটটার দিকে রায়পুরা উপজেলার ইটাখোলায় এলাকায় ঢাকা–সিলেট মহাসড়কে মোটরসাইকেলে মাইক্রোবাসের চাপায় দেহরক্ষী মনির হোসেনসহ নিহত হয়েছিলেন শাহান শাহ আলম। হাইওয়ে পুলিশ তদন্ত শেষে একে দুর্ঘটনা ও মাইক্রোবাসের চালক মাসুদ শেখকে পলাতক দেখিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। পরে শাহান শাহের ভাই ওই মামলায় আদালতে নারাজি দেন। তখন আদালত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব দেন।

আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআইয়ের প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ মামলা তদন্তের ফলাফল তুলে ধরেন সংস্থার প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, ২০১৯ সালে পূর্ব শত্রুতার জেরে নরসিংদীর লোচনপুর বাজারে প্রকাশ্যে বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি দুলাল গাজীকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করেন স্থানীয় কেব্‌ল সংযোগ ব্যবসায়ী শাহান শাহ ও তাঁর সহযোগীরা। এ ঘটনায় নিহত ব্যক্তির ছেলে রবিন গাজী হত্যা মামলা করেন। তখন তাঁকে একটি মামলায় ফাঁসিয়ে কারাগারে পাঠান শাহান শাহ। একপর্যায়ে রবিন গাজীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর বাবা হত্যা মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। শাহান শাহ আলমের বিরুদ্ধে চারটি হত্যাসহ ১০টি মামলা এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সংস্থাই তাঁকে গ্রেপ্তার করেনি। তাই তাঁর বিরুদ্ধে কেউই সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছিলেন না।

২০২১ সালের ১০ এপ্রিল শাহান শাহ আলমকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। তিনি কারাগারে থাকাকালে চারজন সাক্ষী তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। দুই মাসের মাথায় জামিনে বেরিয়ে যান শাহান শাহ আলম। তাঁরা কারামুক্তির দিনই আদালতে জবানবন্দি দেওয়া নাঈম আহমেদ (২৩) ও জুয়েলকে (২২) নরসিংদী বেলাব থানার দড়িকান্দি এলাকায় ‘ডাকাত’ বলে গুজব ছড়িয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

বনজ কুমার মজুমদার বলেন, শাহান শাহ আলম জামিনে বেরিয়ে এসে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ এবং তাঁকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে পুলিশ সদর দপ্তরে দরখাস্ত করেন। পুলিশ ওই ঘটনা তদন্তের জন্য নরসিংদী পুলিশ সুপারকে দায়িত্ব দেয়। নরসিংদী পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সাক্ষ্য দিয়ে শাহান শাহ তাঁর দেহরক্ষী মনিরকে নিয়ে ফেরার সময় মাইক্রোবাসের চাপায় নিহত হন।

পিবিআই প্রধান বলেন, তদন্তে উঠে এসেছে শাহান শাহ আলমকে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যার পেছনে রয়েছেন ওমর ফারুক মোল্লা নামে তাঁর (শাহান শাহ) এলাকার এক ব্যক্তি। এলাকায় আধিপত্য ও স্থানীয় নির্বাচন সামনে রেখে শাহান শাহকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। টাকার বিনিময়ে তিনি এই কাজে লাগিয়েছিলেন তাঁদের এলাকার বাসিন্দা মাসুদ মিয়া, সোহেল মিয়া, মামুন মিয়া ও মাসুম মিয়াসহ কয়েকজনকে। ঘাতক মাইক্রোবাসটির চালক মাসুমকে গ্রেপ্তারের পর শাহান শাহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্য ব্যক্তিদের বিষয়ে জানা যায়।

পিবিআইয়ের নরসিংদী পুলিশ সুপার এনায়েত হোসেন মান্নান জানান, শাহান শাহ আলম ও তাঁর দেহরক্ষী হত্যায় এ পর্যন্ত ৯ জনের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। আগামী সপ্তাহে তাঁদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নরসিংদী পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) আশরাফ আলী জানান, এ হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে তিনজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বাকি পাঁচ আসামি পলাতক।

শাহান শাহের বিরুদ্ধে মামলার দুই সাক্ষী নাঈম ও জুয়েলকে হত্যার পেছনে কারা ছিল, সে প্রশ্ন করা হয়েছিল পিবিআই প্রধানকে। জবাবে তিনি বলেন, এর সঙ্গে শাহান শাহ আলমের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। তবে মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। তারা এ বিষয়ে নিশ্চিত করে বলতে পারবে।

Share