সালমান শাহ’র সব তদন্তেরই ফল ‘আত্মহত্যা’

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক :  বাংলা চলচ্চিত্রের নায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকাবস্থায় মৃত্যু হয় সালমান শাহের
নিজের বাসায় সালমান শাহের মরদেহ উদ্ধার হওয়ার পর প্রথমে অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেছিলেন তার বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী (প্রয়াত)। পরে সেই মামলাটি দুই দফায় তদন্ত করে ডিবি। ডিবির তদন্তের পর সেটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত করার আবেদন জানান কমরউদ্দিন আহমদ। তখন আদালতের নির্দেশে মামলাটি তদন্ত করে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাদের কার্যক্রমের পর মামলাটির বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয়। এরপর এর তদন্তভার যায় র‌্যাবের কাছে। আদালতের নির্দেশে মাঝপথে র‌্যাবের তদন্ত বন্ধ হলে মামলাটির দায়িত্ব বর্তায় পিবিআইয়ের ওপর। ডিবি, সিআইডি এবং বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ তদন্তের ফলাফলে যে কথা বলেছিল, সবশেষ তদন্ত সংস্থা পিবিআইও সেই একই কথাই বললো; সালমানের মৃত্যু আত্মহত্যাজনিত। তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হননি। পারিবারিক কলহ এবং পুঞ্জীভূত অভিমানই তাকে ঠেলে দিয়েছে আত্মহত্যার দিকে।

সবশেষ পুনঃতদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তাদের কার্যক্রম ও প্রাপ্তি নিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদন সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সংবাদ সম্মেলন করে উপস্থাপন করে। রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই সদর দফতরে এ সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন সংস্থার প্রধান বনজ কুমার মজুমদার। এসময় পিবিআইয়ের অন্য শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বনজ কুমার বলেন, পিবিআই চিত্রনায়ক সালমান শাহের মৃত্যুর বিষয়ে রুজুকৃত অপমৃত্যু মামলাটির তদন্ত শেষ করেছে। তিন বছর দুই মাসের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, চিত্রনায়ক সালমান শাহ খুন হননি, তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইয়ের উপস্থাপিত ৬০০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে পুরো ঘটনার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়।

শাবনূরের সঙ্গে সালমান শাহ। দু’জনের এ ঘনিষ্ঠতার কারণে স্ত্রী সামিরার সঙ্গে কলহ লেগেছিল সালমানের

প্রতিবেদনে সালমান শাহের মরদেহ উদ্ধার-পরবর্তী ঘটনার বিষয়ে বলা হয়, সালমান শাহের বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী পুলিশকে জানান, সেদিন (১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে ঢাকার নিউ ইস্কাটন রোডের ১১/বি ইস্কাটন প্লাজার বাসায় তার ছেলের সাথে দেখা করতে যান তিনি। সেখানে গিয়ে সালমান ঘুমাচ্ছেন শুনে তিনি ফিরে যান। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে চলচ্চিত্র প্রোডাকশন ম্যানেজার সেলিম তাকে ফোন করে জানান, সালমানের যেন কী হয়েছে এবং তাকে দ্রুত ওই বাসায় যেতে বলেন। তখন তিনি তার স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে দ্রুত ওই বাসায় গিয়ে দেখেন, সালমান তার শয়নকক্ষে মরার মতো পড়ে রয়েছেন।

তখন তারা উপস্থিত লোকজনের সহায়তায় সালমানকে বাসা থেকে বের করে দ্রুত নিকটস্থ হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে যান। যাওয়ার পথে তারা সালমান শাহের গলায় দড়ির দাগ এবং মুখমণ্ডল ও হাত-পা নীলাভ বর্ণের দেখেন। হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক সালমান শাহকে মৃত ঘোষণা করেন।

সালমানের বাবার লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রমনা মডেল থানায় অপমৃত্যু মামলা নথিভুক্ত হয়। প্রথমে থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাহবুবুর রহমান মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করেন এবং মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য প্রেরণ করেন। ডা. তেজেন্দ্র চন্দ্র দাস মরদেহের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট প্রস্তুত করেন। তিনি মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে মতামত দেন যে, ‘মৃত্যু ফাঁসের দরুণ ঝুলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে সম্পন্ন হয়েছে, যা মৃত্যুপূর্ব ও আত্মহত্যাজনিত’।

স্ত্রী সামিরার সঙ্গে সালমান শাহ। সালমানের আত্মহত্যার পেছনে স্ত্রীর সঙ্গে কলহও দায়ী বলে তদন্তে উঠে এসেছে

তবে কমরউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তভার ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়। ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার হুমায়ুন কবীর পান এ মামলার তদন্তভার। তার অধীনে ১৯৯৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সালমান শাহের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে পুনরায় সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করা হয়। ডা. নার্গিস আরা চৌধুরী ময়নাতদন্ত রিপোর্ট প্রস্তুত করেন। মামলার তদন্ত শেষ করে সালমান শাহের মৃত্যু ‘আত্মহত্যাজনিত’ উল্লেখ করে ১৯৯৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ‘চূড়ান্ত রিপোর্ট’ দাখিল করেন ডিবির কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর।

ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে বাদী নারাজি আবেদন করলে মামলাটি পুনঃতদন্তের আদেশ দেন আদালত। তখন ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার মজিবুর রহমান পুনঃতদন্তের ভার গ্রহণ করেন।

তদন্তের একপর্যায়ে ১৯৯৭ সালের ১৯ জুলাই রেজভী আহমদ ওরফে ফরহাদ (২০) নামে এক যুবক মিথ্যা পরিচয়ে (লেলিন নামে) সালমান শাহের বাসায় গেলে তাকে ধরে ক্যান্টনমেন্ট থানায় সোপর্দ করা হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের হয় (মামলা নং-৩৭(০৭)৯৭)। ওই মামলায় তাকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়। রেজভী আদালতে সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে মর্মে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।

এমতাবস্থায় বাদী আদালতে অপমৃত্যু মামলাটি পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারায় হত্যা মামলায় রূপান্তর করে তদন্তভার সিআইডিকে অর্পণের আবেদন করেন। তখন অপমৃত্যু মামলাটি তদন্তাধীন থাকায় আবেদনটিসহ রেজভীর জবানবন্দির বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে আইজিপিকে নির্দেশ দেন আদালত।

সিআইডি সিটি জোন ঢাকার সহকারী পুলিশ সুপার খালেক উজ-জামান অপমৃত্যু মামলাটিসহ হত্যা মামলার আবেদন ও রেজভী আহমদের জবানবন্দির বিষয়ে তদন্তভার নেন। তার তদন্তকালে একজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে জিজ্ঞাসাবাদে রেজভী ভিন্ন বক্তব্য দেন। তিনি দাবি করেন, তিনি সালমানের মৃত্যুর বিষয়ে কিছুই জানেন না। সালমানের একজন ভক্ত হিসেবে তার ব্যবহৃত কাপড়-চোপড় ও ছবি সংগ্রহের জন্য ওই বাসায় গিয়েছিলেন তিনি।

পিবিআইয়ের সংবাদ সম্মেলন

রেজভী আরও দাবি করেন, ক্যান্টনমেন্ট থানায় ও পরবর্তীতে আদালতে যে জবানবন্দি লেখা হয়েছে, সেটা তার নিজের কোনো বক্তব্য ছিল না। তাকে ক্যন্টনমেন্ট থানায় মারধর করা হয়। সালমানের মা-বাবা, ওসি ও দুই জন এসআই তাকে সালমানের হত্যার ব্যাপারে ‘স্বীকারোক্তি’ দিতে প্ররোচিত করেন।

তার এই স্বীকারোক্তি আদায়সহ অন্যান্য তদন্ত শেষে সিআইডি রিপোর্ট উপস্থাপন করে। ১৯৯৭ সালের ২ নভেম্বর আদালতে উপস্থাপিত ‘চূড়ান্ত রিপোর্টে’ সিআইডির পক্ষ বলা হয়, চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে সালমান শাহের অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা থাকায় তার ও স্ত্রী সামিরার মধ্যে দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি হয়। সৃষ্ট এ দাম্পত্য কলহের কারণেই সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন। সালমান শাহের মৃত্যু পরিকল্পিত কোনো হত্যাকাণ্ড নয়। রেজভী আহমদের জবানবন্দিও সাজানো এবং সালমান শাহের মৃত্যুটি ‘আত্মহত্যাজনিত’।

সিআইডির ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধেও নারাজির আবেদন করেন বাদী। আদালত ওই আবেদন নামঞ্জুর করলে বাদী ১৯৯৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর নামঞ্জুর আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মেট্রো ক্রিমিনাল রিভিশন মামলা (নং-২৭৬/৯৯) দায়ের করেন। তখন আদালত মামলাটির বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দেন।

বিচার বিভাগীয় তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক ২০১৪ সালের ৯ জুলাই এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে বলা হয়, প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণাদি ও সামগ্রিক বিষয়াদি পর্যালোচনায় অভিযোগকারীর (বাদী) আনীত অভিযোগের (হত্যা) প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়নি।

সালমান শাহের মা নিলুফার চৌধুরী ওরফে নীলা চৌধুরীর বিচার বিভাগীয় এ তদন্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধেও নারাজি আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত মামলাটি র্যাবকে তদন্তের নির্দেশ দেন।

এতে রাষ্ট্রপক্ষ সংক্ষুব্ধ হয়ে আদালতে ফৌজদারি রিভিশন মামলা (নং-৩৫৮/২০১৫) দায়ের করে। দীর্ঘ শুনানি শেষে আদালত র্যাব কর্তৃক তদন্তের আদেশ রহিত করেন। একইসঙ্গে নিম্ন আদালতকে বাদীর নারাজির দরখাস্ত আইনানুযায়ী নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। পরে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন।

২০১৬ সালের ২০ ডিসেম্বর পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) পুলিশ পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম (বাবুল) মামলাটির তদন্তভার নেন।

পিবিআইয়ের তদন্তের বিস্তারিত তুলে ধরে সংস্থার প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, মামলার তদন্তভার গ্রহণের পর পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম, পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ জুয়েল মিঞা ও পুলিশ পরিদর্শক হুমায়ূন কবির মোল্লার সমন্বয়ে একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়। তদন্তকালে ঘটনার সময় উপস্থিত ও ঘটনার সহিত সংশ্লিষ্ট ৪৪ সাক্ষীর জবানবন্দি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হয়। এছাড়া ১০ সাক্ষীর সাক্ষ্য ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হয় এবং ঘটনা সংশ্লিষ্ট আলামত জব্দ করা হয়।

পিবিআই তদন্তকালে প্রথম ও দ্বিতীয় সুরতহাল রিপোর্ট, ভিসেরা রিপোর্ট, কেমিক্যাল রিপোর্ট, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট, বিশেষজ্ঞ মেডিকেল বোর্ড কর্তৃক মতামত, হস্তলিপি বিশারদের মতামত, ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও বিল্ডিংয়ে প্রবেশ এবং বাহির সংক্রান্তে বিশেষজ্ঞের মতামত, রিজভী আহমেদ ও জরিনা বেগমের অডিও রেকর্ড, সাক্ষীদের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি, ঘটনা সংশ্লিষ্ট সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রেকর্ডকৃত জবানবন্দি, জব্দকৃত আলামত পর্যালোচনা, পূর্ববর্তী তদন্ত প্রতিবেদনসমূহ পর্যালোচনা, বিভিন্ন দালিলিক সাক্ষ্য, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য, কাগজপত্র ও অন্যান্য সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে। এসব সার্বিক কার্যক্রমের ওপরই পিবিআই প্রস্তুত করেছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন।

তদন্তের ফলাফল জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সালমান শাহ খুন হননি এবং তার মৃত্যুর ঘটনাটি ‘আত্মহত্যাজনিত’। পিবিআইয়ের তদন্ত অনুসারে, সালমান শাহকে পাঁচটি কারণ আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে। সেই পাঁচটি কারণ হলো- চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে সালমান শাহের অতিরিক্ত অন্তরঙ্গতা; স্ত্রী সামিরার সাথে দাম্পত্য কলহ; মাত্রাধিক আবেগপ্রবণতার কারণে একাধিকবার আত্মঘাতী হওয়ার বা আত্মহত্যার চেষ্টা; মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা জটিল সম্পর্কের বেড়াজালে পড়ে পুঞ্জীভূত অভিমানে রূপ নেয়া এবং সন্তান না হওয়ায় দাম্পত্য জীবনে অপূর্ণতা।

Share