গাজী আবু বকর : অক্টোবরের প্রথম ২০ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১২৫ কোটি ৭০ হাজার ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ডলার ১১০ টাকা হিসাবে ১৩ হাজার ৭৫০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। পাশাপাশি বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে গতকাল রোববার থেকে প্রণোদনার পরিমান দ্বিগুন করা হয়েছে। এখন থেকে প্রবাসীদের আয় রেমিট্যান্সের এক ডলারে মিলবে ১১৫ টাকা ৫০ পয়সা। বর্তমানে ব্যাংকসমূহে রেমিট্যান্সের এক মার্কিন ডলারের ক্রয় মূল্য ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। এর ওপর সরকার আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেয়। এতদিন এক ডলারে প্রবাসীরা পাচ্ছিলো ১১৩ টাকা। এখন এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো দেবে আরও ২ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়তি দাম। মূলত বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে ব্যাংকগুলোকে লোকসান দিয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে নতুন নিয়মে এখন বৈধ পথে দেশে রেমিট্যান্স পাঠালে মোট ৫ শতাংশ প্রণোদনা মিলবে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকগুলোতে এখন রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে ডলারের মূল্য ১১০ টাকা। আমদানিকারকদের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। আন্তঃব্যাংক ব্যবস্থায় ডলারের মূল্যও ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু খোলা মুদ্রাবাজারে ডলারের দর ১১৮ টাকা। যার কারণে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন প্রবাসীরা। ফলে আনুষ্ঠানিক বা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক রেমিট্যান্স। কেননা এই সূচকের বাড়া-কমার ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে রিজার্ভের উত্থান-পতন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, অক্টোবরের প্রথম ২০ দিনে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংগুলোর মাধ্যমে ১০ কোটি ১৫ লাখ ২০ হাজার ডলার, বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৪ কোটি ১৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার। আর বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১১০ কোটি ৩১ লাখ ১১ হাজার ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৩৯ লাখ ১০ হাজার ডলার। তবে আলোচিত সময়ে কোনো রেমিট্যান্স আসেনি এমন ব্যাংকের সংখ্যা রয়েছে ৭টি। এসব ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা বিডিবিএল, বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক বা রাকাব। আর বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে- কমিউনিটি ব্যাংক, সিটিজেনস ব্যাংক। বিদেশি খাতের হাবিব ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এবং উরি ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে গত সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স এসেছিল। আলোচ্য মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার এবং আগস্টে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার।
বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ৭ লাখ মার্কিন ডলার। আগের ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ হয়েছিল। যার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার।
২০১৯-২০ অর্থ বছরে প্রথমবারের মতো রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্তের কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় পাঠানোর পরিমাণ বেড়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন বা এক হাজার আটশ’ ২০ কোটি মার্কিন ডলার, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১৩ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ২৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি।
এর আগে গত ২১ অক্টোবর শুক্রবার বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্ততায় অনুষ্ঠিত ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেইঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) এক ভার্চুয়াল যৌথ সভায় রেমিট্যান্সের প্রতি ডলারের ক্রয়মূল্য ১১০ টাকা ৫০ পয়সার সঙ্গে ব্যাংকসমূহের পক্ষ থেকে আরও ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রনোদনা দিয়ে ১১৩ টাকা দরে ডলার ক্রয়ের অনুমতি দেয়া হয় । গত শনিবার এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে ব্যাংকগুলোতে চিঠি দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২২ অক্টোবর রোববার থেকে ব্যাংকগুলো প্রতি ডলারে ১১০ টাকার সঙ্গে আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দিতে পারবে। তবে আমদানি ডলার বিক্রির দর ১১০ টাকা ৫০ পয়সা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ডলার কেনার সর্বোচ্চ দরের চেয়ে বিক্রির দর কম হওয়ার সিদ্ধান্তে ব্যাংকারদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে ডলার বিক্রির আসল দর আড়াল করে আমদানিকারকদের থেকে বাড়তি টাকা নেওয়া বৈধতা পাবে বলে মনে করেন কেউ কেউ।
বর্তমানে প্রবাসীদের আয়ে ব্যাংকে এক মার্কিন ডলারের দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। এর ওপর সরকার আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেয়। এখন এক ডলারে পাচ্ছে ১১২ টাকা ৫০ পয়সা। এখন এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো দেবে আরও ২ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়তি দাম। ফলে রেমিট্যান্সের এক ডলারে মিলবে ১১৫ টাকা ৫০ পয়সা। রোববার থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে বলে জানান বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আফজাল করিম। ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, নির্ধারিত দামে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। তাই রেমিট্যান্স হাউসগুলো থেকে বেশি দামে প্রবাসী আয় কিনতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ডলার সংকট কাটাতে এমন সিদ্ধান্ত। তাদের ধারণা, নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে ‘আগ্রহী হবে’। তারা বলছেন, এটা আরও বাড়াতে হবে। তা না হলে ‘হুন্ডিওয়ালাদের’ সঙ্গে পারাটা মুশকিল হয়ে যাবে। তাদের মতো বাজারের ওপর ডলারের দাম ছেড়ে দেওয়াটাই হবে ‘যৌক্তিক সিদ্ধান্ত’। একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি বলেন, ‘বর্তমানে অনেক ব্যাংকই ডলার সংকটে রয়েছে। অনেকেই এলসি খুলতে পারছে না। প্রবাসীদের আয় বাড়ানোর জন্য এবিবি ও বাফেদার পদক্ষেপটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এতে প্রবাসীদের আয় বাড়বে। ডলার সংকট অনেকটাই কেটে যাবে।’ বেশ কিছুদিন ধরেই ডলার-সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো বাফেদা ও এবিবির বেঁধে দেওয়া দরের চেয়ে পাঁচ-ছয় টাকা বেশি দামে প্রবাসী আয় কিনছে। ফলে প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম বেড়ে হয়েছে ১১৫-১১৬ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনানুষ্ঠানিক পরামর্শেই ব্যাংকগুলো ডলারের এই দাম দিচ্ছে। এক বছরেরও বেশি সময় ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে। তাতে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ৮৫ টাকা থেকে বাড়তে বাড়তে কিছু ক্ষেত্রে ১১১ টাকা পেরিয়েছে। আর খোলা বাজারে তা ১২০ টাকায় উঠেছে। তাই প্রয়োজনের সময় ডলার কিনতে হিমশিম খেতে হয়।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত প্রতিনিয়ত কমছে। এবারে এক সপ্তাহের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে প্রায় ১১ কোটি ডলার। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ কমে ২১ বিলিয়ন বা ২ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের নিচে নেমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী গত ১৮ অক্টোবর বুধবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৯৬ কোটি ডলার। এর এক সপ্তাহ আগে অর্থাৎ ১১ অক্টোবর ছিল ২ হাজার ১০৭ কোটি ডলার। ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি বা ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। গত বছরের ১৮ অক্টোবর সেই রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬১১ কোটি ২৬ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। গত বুধবার তা ২ হাজার ৬৬৮ কোটি ডলারে নেমেছে। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেওয়া হয়। সেই হিসাব প্রকাশ করা হয় না। আইএমএফ সূত্রে জানা গেছে, সেই হিসাবে দেশের প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১ হাজার ৭০০ কোটি বা ১৭ বিলিয়ন ডলারের কম।