২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা : আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও পাকিস্তানিদের প্রতিক্রিয়া

দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্য যে সংগ্রামের সূচনা করেন, সেটাকে ক্রমেই এগিয়ে নিয়ে যান স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে। দেড় যুগের বেশি সময় নিয়ে জাতির মনন প্রস্তুতের পর ঘোষণা করেন ‘বাঙালির বাঁচার দাবি’ ছয় দফা।

জনগণের তুমুল অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যেতে থাকেন নেতা। পাকিস্তানি শোষক ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বহুমুখী ষড়যন্ত্র, মামলা, জেল-জুলুম মোকাবিলা করে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। এরপর ১৯৭১ সালের শুরু থেকেই জোরদার করেন গণতান্ত্রিক আন্দোলন। সাত কোটি বাঙালি প্রত্যেকে পরিণত হয় একেকটি আদমবোমায়।

মার্চের শুরুতেই দেশের একক নিয়ন্ত্রণ চলে আসে বঙ্গবন্ধুর হাতে। প্রত্যেক দিন নতুন নতুন নির্দেশনা দিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য জাতিকে গড়ে তোলেন তিনি। এরপর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদাররা ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে, আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে, অয়্যারলেসের মাধ্যমে বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ঘোষিত হলো স্বাধীনতার ঘোষণা। এর পরপরই, সেই বার্তা টুকে নিয়ে সাইক্লোস্টাইল করে বিলি করা হলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো আন্তর্জাতিক বিশ্বে। জান্তাদের আর কিছুই করার থাকলো না। এমনকি কূটনৈতিকভাবেও বঙ্গবন্ধু এবং বাঙালি জাতিকে নিয়ে অপপ্রচারের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলো জান্তাদের জন্য।

স্বাধীনতার সেই ঘোষণা : পাকিস্তানি জান্তারা ২৫ মার্চ রাতে আক্রমণে নামার পর, বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার বাংলা অনুবাদটি সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

স্বাধীনতার সেই ঘোষণাটি হলো (অনুদিত) : ‘ইহাই হয়তো আমাদের শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।’ -শেখ মুজিবুর রহমান, ২৬ মার্চ ১৯৭১।

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা দলিল : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ইনটেলিজেন্স এজেন্সি (ডিআইএ)-এর স্পট রিপোর্টে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ডিআইএ স্পট রিপোর্ট ৪৩ এর ১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: পাকিস্তানের পূর্ব অংশকে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান।

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য : সেই রাতে অয়্যারলেসের মাধ্যমে ইংরেজিতে স্বাধীনতার যে ঘোষণা দেওয়া হয়, সেই বিষয়ে ব্রিটেনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক ডেভিড লোশাক লিখেছেন, ‘…শব্দ খুব ক্ষীণ ছিল। খুব সম্ভবত, ঘোষণাটি আগেই রেকর্ড করা ছিল।’

সেই সময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এডওয়ার্ড হিথ। তিনি পরবর্তীতে মন্তব্য করেছিলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। ইউরোপের জেনারেলরা মনে করেন, শেখ মুজিব জীবিত থাকুন বা না থাকুন, তারা (পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা) আর বাঙালি জাতিকে সম্পূর্ণ পরাজিত করতে সমর্থ হবে না।’

বিবিসি ও এনডিপি-এর সংবাদ : ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাত ৯টা ৭ মিনিটে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি, এনডিপি ও পিটিআই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ প্রচার করে। ২৬ মার্চ রাত ৮টা ২১ মিনিটে ইউনাইটেড নিউজ অব ইন্ডিয়ার সংবাদে বলা হয়, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস : বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সংবাদ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম পত্রিকা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। স্বাধীনতা ঘোষণার কিছুক্ষণ পর পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে পাকিস্তান রেডিওতে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

দ্য ডেইলি টাইমস : ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ দ্য ডেইলি টাইমস এর সংবাদে বলা হয়েছে, বীরোচিতভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের জবাব দিয়েছেন বাঙালি জাতির সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেছেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’

দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস : ২৭ মার্চের সংবাদে দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানায়, শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা দিলে সেখানে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

দ্য প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া : ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে সকালেই সংবাদ প্রকাশ করেছে ভারতের গণমাধ্যম দ্য প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া। খবরে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে একটি সার্বভৌম ও স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের নিকটবর্তী একটি বিশেষ বেতার বার্তার মাধ্যমে তিনি এই ঘোষণা দিয়েছেন।

দ্য গার্ডিয়ান : বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ২৭ মার্চ সংবাদ প্রকাশ করেছে ব্রিটেনের অন্যতম পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান। পত্রিকাটি জানায়, গ্রেফতার হওয়ার আগে মুজিব তার দেশের মানুষের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। জনগণের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, ‘আজ থেকে তোমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক।’

দ্য স্টেটসম্যান : ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ দিল্লির স্টেটসম্যান পত্রিকায় বলা হয়, হানাদার বাহিনী কর্তৃক ক্রাকডাউনের জবাবে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর ও এই অঞ্চলের হানাদার বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিল টিক্কা খান। তার নির্দেশেই ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর নামে বাঙালি জাতির ওপর গণহত্যা শুরু হয়। পরে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি ওরফে একে নিয়াজি। নিয়াজি এবং রাও ফরমান আলী খানরা (নিয়াজির উপদেষ্টা) বেশ আগে থেকেই ঢাকায় অবস্থান করছিল। পরবর্তীতে, সার্ক সম্মেলনের একটি অনুষ্ঠানের পর, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যার প্রসঙ্গে টিক্কা খানকে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা।

পাঞ্জাবের সরকারি গভর্নরের হাউজের দোতলায় বসে ওই রাতের অভিযানের কথা স্বীকার করে টিক্কা খান। সেই রাতে নিজের কানে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার কথাও জানায় সে।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার ব্যাপারে টিক্কা খান বলেছে, ‘‘আমার কো-অর্ডিনেশন অফিসার একটি তিন ব্যান্ড রেডিও নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলেছিল- ‘স্যার, শুনুন! শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন।’ এবং আমি নিজেও রেডিওর এক বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে সেই স্বাধীনতার ঘোষণা শুনি। শেখ সাহেবের কণ্ঠ আমি ভালো করেই চিনতাম। শেখ সাহেবকে গ্রেফতার করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।’’

তবে সেই রাতে অন্যান্যদের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান আত্মগোপনে চলে গেলে পাকিস্তানিদের করণীয় কী হতো, এ ব্যাপারে জানতে চাইলে টিক্কা জানায়, ‘আমি ভালো করেই জানতাম, শেখ মুজিবের মতো নেতা তার নিজের লোকদের ছেড়ে কোথাও যাবেন না। আমি শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করার জন্য ঢাকার সব জায়গায়, প্রতিটি বাড়ি-ঘরে, এমনকি প্রতিটি কোণায় কোণায় তল্লাশি চালাতাম। অন্য কোনো নেতাদের গ্রেফতার করার ইচ্ছা ছিল না আমার। এজন্য তারা খুব সহজেই ঢাকার বাইরে চলে যেতে পেরেছিল।’

দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেও বাংলাদেশের কিছু লোক পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে ছিল বলেও জানায় সে। সেই সাক্ষাৎকারে টিক্কা খান আরো বলেছে, ‘বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক নেতা আমাদের সঙ্গে ছিলেন।… গোলাম আজমসহ অনেকে এখনো মনে করেন না যে আমরা ভুল করেছি।’

উল্লেখ্য যে, পুরো সময়টাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছিলেন জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক। পরবর্তীতে, যুদ্ধ-দিনের স্মৃতি নিয়ে ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ নামে একটি গ্রন্থ লিখেছেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতের নারকীয় হামলা থেকে শুরু করে, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, এমনকি ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ, হানাদার বাহিনীর অভ্যন্তরীণ অনেক ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এই গ্রন্থে।

২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাতের ব্যাপারে সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, ‘রাস্তায় দেরি হতে পারে এই ধারণার কারণে রাত প্রায় সাড়ে ১১টা থেকে সেনানিবাস ত্যাগ করতে শুরু করে অনেকে। ইতিমধ্যে যারা বেতার, টেলিভিশন কেন্দ্র, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, বিদ্যুৎ, ব্যাংক ইত্যাদির নিরাপত্তার জন্য শহরে অবস্থান করছিল, অপারেশন শুরু হওয়ার আগেই তারা নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে যায়।… নির্ধারিত সময়ের আগেই হামলা শুরু হয়। যেনো ইচ্ছাকৃতভাবে নরকের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হলো…’

ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১টা ৩০ মিনিটে গ্রেপ্তার করে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে নেওয়া হয়। পাকিস্তানে নেওয়ার পর বিভিন্ন পত্রিকায় এ ছবি প্রকাশিত হয়।

পাকিস্তানি হানাদাররা ঢাকার ঘুমন্ত মানুষের ওপর হামলে পড়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসের বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বলেও উল্লেখ করেন একে নিয়াজির প্রেস সেক্রেটারি সিদ্দিক সালিক। তিনি লিখেছেন, ‘প্রথম গুলিবর্ষণের পরপর, পাকিস্তানের সরকারি বেতারের কাছাকাছি তরঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের কন্ঠের ক্ষীণ শব্দ শোনা যায়। মনে হলো রেকর্ডকৃত বাণী। শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।’

Share