নয়াবার্তা প্রতিবেদক : মাঠ পর্যায়ে একসঙ্গে এত কর্মকর্তার বদলি নিকট অতীতে আর হয়নি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) চাওয়া অনুযায়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিলে এরই মধ্যে ৫৪৩ জনকে বদলির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪৭ ইউএনওর বদলি দু’দিন আগে কার্যকর হয়। বাকিদের বদলি আদেশ হতে পারে আজ শুক্রবার। বেশির ভাগ ইউএনওকে পাশের জেলায় বদলি করা হয়েছে। এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে বদলি করা হয়েছে ৩৩৮ ওসিকে। তবে এই রদবদলই শেষ নয়, শিগগির আরও কিছু কর্মকর্তাকে বদলি করা হবে বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে।
জনপ্রশাসন বিষয়ে অভিজ্ঞরা বলছেন, ২০০১ সালের পর এত বড় বদলি মাঠ প্রশাসনে হয়নি। তাদের মতে, পুলিশ বা প্রশাসন সরকারের ইচ্ছায় চলে। তাই এই রদবদল খুব অর্থবহ নয়। এতে শুধু অর্থের অপচয় হবে।
নিয়ম অনুসারে, একজন সরকারি কর্মচারীকে বদলি করা হলে তিনি তাঁর বেতন গ্রেড অনুসারে বদলিজনিত ভাতা পান। তাঁর পরিবারের সদস্যরাও কিলোমিটার হিসাবে ভাতা পান। বাড়ির আসবাব স্থানান্তরের জন্য ট্রাক ভাড়া দিতে হয় সরকারকে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ১৫৮ ইউএনও বদলি অনুমোদন করেছে ইসি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাদের বদলির দুটি প্রস্তাব পাঠালে ইসি অনুমোদন করে। এর মধ্যে বুধবার ১১০ ও গতকাল ৪৮ ইউএনওর তালিকা ইসিতে পাঠানো হয়। এর আগে গত ৪ ডিসেম্বর প্রথম ধাপে ৪৭ ইউএনওকে বদলির অনুমোদন দেয় ইসি। কমিশনের চাওয়া অনুযায়ী ২০৫ ইউএনওকে বদলি করা হচ্ছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, প্রথম ধাপে কর্মস্থলে দুই বছরের বেশি দায়িত্ব পালনকারী ইউএনওদের বদলি হয়। এবার এক বছরের বেশি বর্তমান কর্মস্থলে দায়িত্ব পালনকারী ইউএনওদের বদলি করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানান, এ পর্যন্ত ২০৫ ইউএনও এবং ৩৩৮ ওসিকে বদলি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে ইসি। সিদ্ধান্ত ছিল, ওসিদের মধ্যে যাদের বর্তমান কর্মস্থলে ছয় মাসের বেশি হয়েছে তাদের বদলি করার। মোট ৩৩৮ ওসিকে বদলি ও পদায়নে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব এসেছে। কমিশন এতে অনাপত্তি জানিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট রেঞ্জ ও মেট্রোপলিটন পুলিশ তাদের অধীন ওসিদের বদলির আদেশ বাস্তবায়ন করবে।
ইসি সচিব বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে কমিশন প্রস্তাব দিয়েছিল, যেসব ইউএনওর কর্মকাল এক বছর বা তার বেশি হয়েছে তাদের বদলির জন্য। এর আলোকে কমিশনে তিন ধাপে প্রস্তাব এসেছে। প্রথম ধাপে ৪৭ জনের, দ্বিতীয় ধাপে ১১০ জনের এবং তৃতীয় ধাপে ৪৮ জনের বদলির প্রস্তাব এসেছে। মোট ২০৫ ইউএনওর বদলির বিষয়ে কমিশন সম্মতি জানিয়েছে।
সচিব জানান, ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডার থেকে উপজেলা/থানা সহকারী নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে নির্বাচন কমিশন ৮৩ জনের নিয়োগ গতকাল প্রদান করেছে। তারা ১২ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনে যোগদান করবেন।
ইউএনও বদলি : নির্বাচনে ডিসি ও ইউএনওদের বিশেষ ক্ষমতা থাকলেও ২০১৪ সাল থেকে পুলিশ সুপার (এসপি) ও থানার ওসিরা বেশি ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন বলে মনে করে ইসি। বিএনপি নির্বাচনে এলে এই পরির্বতন হতো না বলে মনে করেন অনেক কর্মকর্তা। এ অবস্থায় ইসির চাওয়া অনুসারে দেশের ৪৯৫ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মধ্যে স্টেশনে যাদের এক বছরের বেশি হয়েছে তাদের বদলি করা হচ্ছে। এর আগে গত শনিবার সুনামগঞ্জ ও ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসককেও বদলি করা হয়।
ঢাকার অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) এজেএম নুরুল হক বলেন, ‘এরই মধ্যে এ বিভাগের ১৩ ইউএনওকে বদলি করা হয়েছে। ইসির অনুমোদন পাওয়ায় আরও ৩৫ জনকে আজকালের মধ্যে বদলি করা হবে।’ সবাইকে বিভাগের মধ্যে বদলি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী ইতোমধ্যে আট ইউএনওকে বদলি করা হয়েছে, আরও করা হবে। পরবর্তী নির্দেশনা অনুযায়ী আদেশ দেওয়া হবে।’
ময়মনসিংহের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) তাহমিনা আক্তার জানান, এ বিভাগের ৬ ইউএনওকে বদলি করা হয়েছে। আজ আরও ২১ জনকে বদলি করা হতে পারে।
বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মো. শওকত আলী জানান, ইতোমধ্যে সেখানকার দু’জনকে বদলি করা হয়েছে। ইসি থেকে আরও ১০ ইউএনওকে বদলির অনুমোদন মিলেছে।
রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, তাঁর বিভাগের দু’জন ইউএনও বদলি হয়েছেন। সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার আবু আহমেদ ছিদ্দিকী জানান, এরই মধ্যে সেখানকার ৬ ইউএনওকে বদলি করা হয়েছে। রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর জানান, সেখানে বদলি করা হয়েছে ৬ ইউএনওকে। আরও ২১ জনকে আজ বদলি করা হবে।
বদলিতে সরকারের ব্যয় কেমন : সরকারি কর্মচারীদের বদলিতে আর্থিক সংশ্লেষ রয়েছে। গত বছরের ১৪ জুলাই জারি করা অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুসারে, সরকারি কর্মচারীদের বদলিজনিত ভ্রমণ ভাতা দিতে ৩টি ক্যাটেগরি করা হয়েছে। পঞ্চম থেকে তদূর্ধ্ব কর্মচারীরা প্রথম ক্যাটেগরি, ষষ্ঠ থেকে দশম গ্রেড দ্বিতীয় ক্যাটেগরি, একাদশ থেকে ষোড়শ গ্রেড তৃতীয় ক্যাটেগরি এবং ১৭ থেকে ২০তম পর্যন্ত চতুর্থ ক্যাটেগরি।
প্রজ্ঞাপন অনুসারে, ইউএনও ও ওসিরা দ্বিতীয় ক্যাটেগরিতে পড়েন। বদলিতে তারা দৈনন্দিন ভাতা (ডিএ) পান ৯০০ টাকা করে। তবে ব্যয়বহুল স্থান যেমন ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, রংপুর, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কক্সবাজার, গাজীপুর শহর ও সাভার পৌর এলাকার জন্য সাধারণ এ হারের অতিরিক্ত ৩০ শতাংশ টাকা পান। ভ্রমণ ভাতা হিসেবে ক্যাটেগরি-২ এর অন্তর্ভুক্তরা পরিবারসহ ভ্রমণের ক্ষেত্রে ২৫০০ টাকা (একাকী ভ্রমণের ক্ষেত্রে ১২০০ টাকা) এবং দূরত্বের ভিত্তিতে কিলোমিটারপ্রতি ৪৫ টাকা করে পান। আর বাইরে বাসার মালপত্র সরবরাহের জন্য কিলোমিটার হিসাবে ট্রাক ভাড়া পান।
ক্যাটেগরি-১ ভুক্ত কর্মকর্তারা বদলিজনিত কারণে বিমানেও ভ্রমণ করতে পারবেন। উল্লেখ্য, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা জাতীয় বেতন স্কেলের সপ্তম ও থানার ওসিরা নবম গ্রেডে বেতন পান।
এই দুই গ্রেডের কর্মকর্তাদের গড়ে ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব হিসাব করলে, ৫৪৩ কর্মকর্তার বদলিতে সরকারের কমপক্ষে সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয় হবে। তবে দূরত্বের কম-বেশিতে এ হিসাবেও পরিবর্তন হবে।
ওসি বদলি যেভাবে : দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ৩৩৮ থানার ওসি বদলির অনুমতি দিয়েছে ইসি। গতকাল এ অনুমতি দেওয়া হয়। এর আগে নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে বর্তমান কর্মস্থলে ছয় মাসের বেশি সময় কর্মরত থাকলে এমন ওসিদের বদলির সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে গত ৩০ নভেম্বর ইসির উপসচিব (চলতি দায়িত্ব) মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়। পরে পুলিশ সদরদপ্তর থেকে ওসিদের একটি তালিকা জমা দেওয়া হয় ইসিতে। এরপর বিকেলে পুলিশ সদরদপ্তর থেকে এক অফিস আদেশে ৩৩৮ ওসি বদলি করা হয়। তবে বেশির ভাগ ওসিকে একই জেলা ও মহানগরে রাখা হয়েছে।
একই মহানগরের এক থানা থেকে আরেক থানায় বদলি হলে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো অর্থ দেওয়া হয় না। তবে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় বদলি হলে অর্থ দিতে হয় সরকারি নিয়মে। এর মধ্যে রয়েছে মালপত্র বহনের জন্য দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা, টিএ বিল দেওয়া হয় বর্তমান কর্মস্থল থেকে বদলি হওয়া কর্মস্থল পর্যন্ত দূরত্ব অনুযায়ী। দূরত্ব ২০০ কিলোমিটারের কম হলে প্রতি কিলোমিটার হিসাবে ৮ টাকা এবং ২০০ কিলোমিটারের বেশি হলে কিলোমিটার প্রতি দেওয়া হয় ছয় টাকা। এ ছাড়া বর্তমান কর্মস্থল থেকে বদলি স্থানে পৌঁছার আগ পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ে অবস্থানের জন্য ডিএ হিসেবে দিনে এক হাজার থেকে চার হাজার টাকা দিতে হয়। এই হিসাবে একজন ওসি বদলির পেছনে খরচ হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। তবে দূরত্ব ও পরিবারের সদস্য অনুযায়ী এ হিসাবে কমবেশি হতে পারে।
‘এ বদলি সরকারি অর্থের অপচয়’ : ইউএনও-ওসি বদলির এই হিড়িককে অপ্রয়োজনীয় ও সরকারি অর্থের অপচয় বলে মনে করছেন অনেকে। সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান মনে করেন, ‘এই বদলিতে গুণগত কোনো পরিবর্তন আসবে না। ইউএনও এবং ওসিদের বদলি করে কী হবে? তাদের বদলি করে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা সম্ভব না। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন তো হচ্ছেই না! বিএনপি এবং তাদের সঙ্গে যারা আছে তারা নির্বাচনে নাই। আছে আওয়ামী লীগ, তাদের ডামি প্রার্থী এবং নাম-গোত্রহীন কিছু দল। ফলে নির্বাচন যেমন হওয়ার সেরকমই হবে। মাঝখান থেকে সরকারের অর্থের অপচয় হবে।’
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক অবশ্য বলেন, ‘জনস্বার্থ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বদলি করা হয়ে থাকলে অর্থ অপচয় হলেও মেনে নিতে হবে। তবে অপচয় কমানোর জন্য দূরে না দিয়ে, মহানগর কিংবা জেলার মধ্যেই বদলি করা হয়েছে।’
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচনটা একতরফা হচ্ছে। একটি ভালো নির্বাচনের জন্য যেমন পরিবেশ দরকার, সেটি আগেই নষ্ট হয়েছে। কাজেই কর্মকর্তাদের বদলি অপ্রয়োজনীয়। এটা কোনো ফল আনবে না। বরং বদলিভাতা বাবদ সরকারের বিপুল অর্থ ব্যয় হবে।’