নিজস্ব ডেস্ক প্রতিবেদক : প্রতিদিনের জীবনযাত্রা, অচেতন মনের চিন্তাধারা, নগর জীবনের বাস্তবতা আর এর সাথে জড়ানো অনুভূতিগুলো বিস্ময়কর এক দ্যুতি নিয়ে ফুটে ওঠে কবীর সুমনের গানে। তাই অনেকে তাকে ‘নাগরিক কবিয়াল’ নামে ডাকেন। ‘জীবনমুখী’ গান গাওয়ায় তাকে অনেকে আবার জীবনমুখী গানের গায়কও বলেন। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে এসব বিশেষণকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখান কবীর সুমন। তার কাছে তার গান হলো শুধুই আধুনিক বাংলা গান। তার গানের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো প্রেম। প্রেমকে তিনি বরাবর উপস্থাপন করেছেন কোনো তরুণের সেই প্রথম শিহরণের সাথে, ফুটিয়ে তুলেছেন সেই চিরন্তন আকাঙ্খা, চিরকালের বাসনা, লজ্জাহীন আকুতি আর ব্যার্থতার দীর্ঘশ্বাস; যার ফলে তার গানে প্রেমানুভূতি হয়েছে আরও শক্তিশালী, আরও বাস্তব, আরও সুন্দর ।
আজ এই কিংবদন্তির জন্মদিন। সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনার দিন যাপনের স্রোতে জীবনের ৭২টি বসন্ত দেখছেন বির সুমন। জীবনের বিশেষ দিনটিতে ভক্তদের ভালোবাসা আর শুভেচ্ছায় ভেসে যাচ্ছেন।
কবীর সুমনকে অনেকে বাংলার বব ডিলানও বলে থাকেন। বব ডিলানের ‘ব্লোইং ইন দ্যা উইন্ড’ এর বাংলা রুপান্তর ‘কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়’ দিয়ে বব ডিলানকে বাংলায় একটা অতি চেনা নামে পরিণত করেছেন তিনি। বাংলা গানের নতুন এক ধারার স্রষ্টা তিনি। বাংলা গানে পশ্চিমা প্রভাবের সংমিশ্রণের যে ধারা তিনি প্রবর্তন করেছেন তা কালজয়ী হয়ে উঠেছে শ্রোতাদের কাছে। তিনি একাধারে একজন গায়ক, গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, কবি, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, টিভি উপস্থাপক ও অভিনেতা।
কবির সুমনের প্রথম নাম সুমন চট্টোপাধ্যায়। তবে বাংলাদেশের প্রখ্যাত গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নাম পরিবর্তন করে কবীর সুমন রাখেন তিনি। তবে সুমনের ভাষ্যমতে কবীর নামটি ‘বৈষ্ণব পদাবলি’র রচয়িতা মধ্যযুগীয় বাঙালি কবি শেখ কবীরের নাম থেকে নেয়া।
ওড়িষার কটকের বাঙালি এক হিন্দু ব্রাহ্মন পরিবারে জন্ম সুমনের। সেটা ১৯৫০ সালের ১৬ মার্চ। বাবা সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, মা উমা চট্টোপাধ্যায়। বাবার কাছে ক্লাসিক্যাল মিউজিকের তালিম নেয়া সেই ছোট্টবেলাতেই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক শেষ করে ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষায় ডিপ্লোমা নেন সুমন। এরপর কিছুদিন অল ইন্ডিয়া রেডিও আর ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়াতে কাজ করেন। সত্তরের মাঝামাঝি সুমন গুয়াতেমালায় চলে যান। এক জায়গায় বেশিদিন তিনি থিতু হননি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তিনি স্থান বদল করেছেন। দেখেছেন বিভিন্ন ধাঁচের মানুষ, এসেছেন ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক ধারার সংস্পর্শে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল অবধি তিনি ভয়েস অব জার্মানীর বাংলা বিভাগে কাজ করেন। ফ্রান্সে থাকাকালে সুমন বব ডিলানের গানের ছোঁয়ায় আসেন। সে ছিল তার জন্য এক যুগান্তকারী অভিজ্ঞতা।
১৯৮০ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত কবীর সুমন আমেরিকায় ছিলেন। সেখানে তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগে কাজ করেছেন। এখানে কাজ করার সময় তিনি পিট সিগার, মায়া অ্যাঞ্জেলোসহ বেশ কিছু গুণী সাহিত্যিক ও সঙ্গীত বিষয়ক ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিত হন। আশির দশকের মাঝামাঝিতে সুমন নিকারাগুয়ায় স্যান্ডিনিস্টা বিপ্লব নিয়ে বেশ আগ্রহী হয়ে পড়েন। পিট সিগারের বদৌলতেই সুমনের পরিচয় হয় আর্নেস্টো কার্ডেনালের সাথে। একইসাথে ধর্মযাজক, কবি ও মুক্তিসংগ্রামী আর্নেস্টো কার্ডেনাল ছিলেন সেসময় নিকারাগুয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রী। কার্ডেনালের আমন্ত্রনেই সুমন ১৯৮৫ সালে নিকারাগুয়ায় যান। সেখানে গিয়ে ল্যাটিন আমেরিকার সঙ্গীত জগতে যে নতুন বিপ্লব চলছিল, তার সংস্পর্শে আসেন সুমন।
১৯৮৯ সালে জার্মান ইন্টারন্যাশনাল রেডিওর সাথে দ্বিতীয় চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ করে সুমন কলকাতায় ফিরে আসেন। তখন থেকে শুরু হয় তার দীর্ঘ প্রবাস সঞ্চিত সঙ্গীত অভিজ্ঞতার অনবদ্য এক বহি:প্রকাশ। তার নগর জীবন আর সামাজিক সচেতনতামূলক গানগুলো মানুষের বোধের জগতকে সজজেই নাড়া দেয়। কলকাতায় তিনি প্রথম যোগ দিয়েছিলেন ‘নাগরিক’ ব্যান্ডের সাথে। এই ব্যান্ডের সাথে বের হয় তার দু’টি অ্যালবাম- ‘অন্য কথা অন্য গান ১’ ও ‘অন্য কথা অন্য গান ২’।
কবির সুমনের প্রথম অ্যালমাব ‘তোমাকে চাই’। প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল। প্রথম অ্যালবামের গানেই নিজের শক্তি দেখান তিনি। জানান দেন ভিন্নমাত্রার। বাংলা গানে নতুন মাত্রা যোগ করলো এই অ্যালবাম। দুই বাংলায় সমান আবেদনময়ী ‘তোমাকে চাই’। ২০১০ সাল অবধি সুমনের ২০টির বেশি অ্যালবাম বের হয়। তার গানের প্রভাবে চলে পশ্চিমবঙ্গ ও ঢাকার শিল্পীরা। ‘চন্দ্রবিন্দু’র মতো বেশ কিছু ব্যান্ড তার দ্বারা সম্যক প্রভাবিত হয়ে পথ চলেছে, এখনও চলছে। তাই বলা হয় আধুনিক বাংলা গানে বিপ্লব ঘটে গেছে কবীর সুমনের হাত ধরেই।
নব্বই দশকের পরে গায়ক ও গীতিকারদের একটা পুরো প্রজন্মকে প্রভাবিত করেছেন কবীর সুমন। তার অনুসারীদের মধ্যে আছেন নচিকেতা, অঞ্জন দত্ত, লোপামূদ্রা মিত্র, শ্রীকান্ত আচার্য্যসহ আরও অনেকেই। সুমনের বেশিরভাগ গানই শুধু পিয়ানো, গিটার বা সিনথেসাইজার এর একক তানে তৈরি। ২০১২ এ বের হয় সুমনের ‘৬৩ তে’। এরপর থেকে তিনি রাজনৈতিক ইস্যুতে বেশী নিমগ্ন হয়ে পড়েন। ২০০৯ এর মে থেকে ২০১৪ পর্যন্ত তিনি ইন্ডিয়ান পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
কবীর সুমনের মন কেড়ে নেওয়া সব অ্যালবামের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো তোমাকে চাই (১৯৯২), ইচ্ছে হলো (১৯৯৩), গানওয়ালা (১৯৯৪), ঘুমাও বাউন্ডুলে (১৯৯৫), চাইছি তোমার বন্ধুতা (১৯৯৬), জাতিস্মর (১৯৯৭), নিষিদ্ধ ইশতেহার (১৯৯৮), যাবো অচেনায় (২০০১), লালমোহনের লাশ (২০১০) ইত্যাদি। (তথ্য ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত)