নয়াবার্তা প্রতিবেদক : ব্যাংক থেকে যেভাবে ঋণ যাচ্ছে, সেভাবে ফেরত আসছে না। টাকা আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা হয়, কিন্তু দ্রুত নিষ্পত্তি হয় না। ফলে মামলা ঝুলে থাকে বছরের পর বছর। গত ১৯ বছরে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা ফেরত পেতে মামলা হয়েছে দুই লাখের বেশি।
অথচ এ সময়ে আদায় হয়েছে মাত্র ১৯ হাজার কোটি টাকা। বাকি টাকা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের পকেটে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে দুই ধরনের সমস্যা হচ্ছে। প্রথমত মামলাজট, দ্বিতীয়ত খেলাপিদের বারবার স্থগিতাদেশের কাছে অসহায় ব্যাংকাররা। তাই বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে খেলাপি ঋণ আদায়ের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বিপুল অঙ্কের এ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। ফেরত আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
তবুও পুরোনো পরামর্শ আবার দিচ্ছি- অর্থঋণ আদালত নয়, খেলাপি ঋণ আদায় করতে হলে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। কারণ ট্রাইব্যুনালে আপিলের সুযোগ নেই।
ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপির বিচার করতে হবে। জেলে পাঠাতে হবে। সব সম্পদ ক্রোক করতে হবে। তা না হলে খেলাপি ঋণ আর কখনো ফেরত আসবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থঋণ আদালতে দায়ের করা পুঞ্জীভূত মামলার সংখ্যা ২ লাখ ১ হাজার ৫৮৬টি। এর বিপরীতে দাবির পরিমাণ ১ লাখ ৯৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা।
তবে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত নিষ্পত্তি করা মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৩৬ হাজার ১৪৯টি। এর বিপরীতে প্রকৃত আদায় ১৯ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে অর্থঋণ আদালতে বর্তমানে আটকে আছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৭১৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ঋণ আদায়ের জন্য সাধারণত চার ধরনের আদালতে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। আদালতগুলো হলো অর্থঋণ আদালত, দেউলিয়া আদালত, সার্টিফিকেট আদালত ও দেওয়ানি আদালত।
ব্যাংকগুলো অর্থঋণ আদালতেই বেশিরভাগ মামলা করে। এ আদালতেই ব্যাংকের অধিকাংশ খেলাপি ঋণ আটকে আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সাধারণত প্রতি ৬ মাস পর হালনাগাদ তথ্য দিয়ে মামলার বিবরণী তৈরি করে। সর্বশেষ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে ৩০ জুন ভিত্তিক তথ্য দিয়ে।
মামলার সংখ্যা ও আদায়ের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি-জুন প্রান্তিকের তুলনায় ২০২১ সালের একই সময়ে মামলা নিষ্পত্তি এবং আদায় হয়েছে অনেক কম।
গত ৬ মাসে (জানুয়ারি-জুন) বিচারাধীন মামলার বিপরীতে আটকে থাকা খেলাপি থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ৪ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। কিন্তু ২০২০ সালের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ১৮ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা।
আদালতভিত্তিক মামলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ আটকে আছে অর্থঋণ আদালতে। গত জুনভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা এখন ৬৫ হাজার ৪৩৭টি। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর দাবিকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা।
এর মধ্যে সরকারি ৯ ব্যাংকেরই রয়েছে প্রায় ৬৩ হাজার কোটি টাকা। বেসরকারি ৪০ ব্যাংকের ৭০ হাজার কোটি এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর ২ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বেশি অর্থ আদালতে আটকে আছে। এর কারণ হিসাবে ব্যাংকাররা বলেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগই ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করে।
গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেয়। ফলে তাদের ঋণ আদায়ের হার বেশি। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে সেটা কম দেখা যায়। কারণ সরকারি ব্যাংকগুলোতে অনেক সময় ঋণ দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়।
এসব ঋণ এক সময় আদায় না হওয়ায় কুঋণে পরিণত হয়। আর কুঋণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক পর্যায়ে আদায় হয় না। আদালতে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো তাই অর্থঋণ আদালতসহ অন্যান্য আদালতে মামলা করে থাকে।
কিন্তু আদালত পর্যাপ্ত না থাকায় মামলার নিষ্পত্তি হয় ধীরে ধীরে। এভাবেই খেলাপি ঋণসংক্রান্ত মামলার পাহাড় জমতে থাকে। সরকারি ব্যাংকের মতো এখন কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকেও মামলার সংখ্যা বাড়ছে।
এর কারণ হিসাবে দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বারবার ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেয়ায় যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তারাও এখন নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও কুঋণ বেড়ে যাচ্ছে। আর ঋণ আদায়ের জন্য শেষ পর্যন্ত আদালতে মামলা করতে হচ্ছে। এতে একদিকে ব্যাংকের মামলা পরিচালনায় ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সময়মতো মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় ব্যাংকের টাকা আটকে যাচ্ছে।
ফলে কমে যাচ্ছে ব্যাংকের ঋণ বিতরণের সক্ষমতা। খেলাপি ঋণ আদায়ে ২০০৩ সালে অর্থঋণ আদালত গঠন করা হয়।