ঐতিহাসিক যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরের ১ হাজার ৬’শ ২ বিঘা জমি আত্মসাৎ

গাজী আবু বকর : ১ হাজার ৬’শ ২ বিঘা জমির মালিক হয়েও মাত্র ৭ শতক ভুমির উপর নির্মিত মুল মন্দিরে অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছেন বাংলাদেশের শক্তিপীঠ যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরের কালিকা দেবী। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পবীত্র পুরাণে বর্ণিত একান্ন পীঠের এক পীঠে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক এই কালি মন্দিরে ভক্তরা সড়ক থেকে বেনামী জমি পাড়িয়ে আসছেন পুজা দিতে।

যশোরেশ্বরী কালী মন্দির হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভক্তদের জন্য বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত মন্দির। এ শক্তিপীঠটি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর গ্রামে অবস্থিত। যশোরেশ্বরী নামের অর্থ “যশোরের দেবী”। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য এটি একটি পবিত্র তীর্থস্থান।

জানা যায়, মন্দিরটি আনারি নামের এক ব্রাহ্মণ কর্তৃক নির্মিত হয়। তিনি এই যশোরেশ্বরী শক্তিপীঠের ১০০টি দরজা নির্মাণ করেন। কিন্তু মন্দিরটি কখন নির্মিত হয় তা জানা যায়নি। পরবর্তীকালে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লক্ষণ সেন ও তারো পরে বাংলার ১২ ভূঁইয়াদের অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্য কর্তৃক তাঁদের রাজত্বকালে এটির সংস্কার করা হয়েছিল। মূল মন্দির সংলগ্ন স্থানে নাটমন্দির নামে একটি বৃহৎ মঞ্চমন্ডুপ নির্মাণ করা হয়েছিল। যেখান হতে দেবীর মুখমন্ডল দেখা যায়। এটি ১৯৭১ সালের পর ভেঙে পড়ে। এখন শুধুমাত্র স্তম্ভগুলি দেখা যায়।

এই মন্দির সম্পর্কে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন যে, “সত্য যুগে দক্ষ যজ্ঞের পর সতী মাতা দেহ ত্যাগ করলে মহাদেব সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রলয় নৃত্য শুরু করলে বিষ্ণু দেব সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর মৃতদেহ ছেদন করেন। এতে সতী মাতার দেহ খন্ডসমূহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে পতিত হয় এবং এ সকল স্থানসমূহ শক্তিপীঠ হিসেবে পরিচিতি পায়।

৫১টি শক্তি পীঠের মধ্যে যশোরেশ্বরী মন্দির একটি। ভারত ও ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে এই পীঠগুলো ছড়িয়ে রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি পীঠ রয়েছে বাংলাদেশে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ধারণা করে থাকেন যে, এই ৫১টি পীঠের মধ্যে যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরটি হলো সেই পীঠস্থান, যেখানে দেবী সতীর হাতের তালু ও পায়ের পাতা এসে পড়েছিল।

প্রতিবেশী বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ২০২১ সালের মার্চ মাসে দুই দিনের বাংলাদেশ সফরে এসে ২৭ মার্চ শনিবার সাতক্ষীরার শ্যামনগরের যশোরেশ্বরী কালী মন্দির পরিদর্শন করেন। তিনি ঐদিন সকালে মন্দির পরিদর্শনকালে কৃষ্ণবর্ণ কষ্ঠিপাথরে নির্মিত কালী মূর্তির পূজাঅর্চনা করেন। মন্দিরে প্রবেশের পর রীতি অনুযায়ী ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী দেবীকে মুকুট পরিয়ে দেন। এরপর দেবীর বস্ত্রদান সম্পন্ন করেন তিনি। দেবীকে মাল্যদানের পর যোগাসনে বসে পাঠ করেন পূজার মন্ত্র। পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের পর তিনি দেবীকে প্রদক্ষিণ করেন।

উল্লেখ্য, কোনও বিদেশি সরকার প্রধানের সাতক্ষীরায় এটি ছিলো প্রথম আগমন। আর তাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ দিনের জীর্ণ শীর্ণ মন্দিরটি সংস্কার করা হয়। মোদিকে স্বাগত জানাতে বাঁশের তৈরি নানা রকম কারুকার্যে নান্দনিক রূপে সাজানো হয় যশোরেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণ।

মুঘল শাসনামল থেকে ঐতিহাসিক এই মন্দিরটির সকল প্রকার রেকর্ডপত্রে সার্বজনীন মন্দিরের কথা উল্লেখ রয়েছে। অথচ মন্দিরটির ব্রিটিশ শাসনামলের চার সেবায়েত এর মধ্যে এক সেবায়েত “জ্ঞান চট্রোপধ্যায় অধিকারীর” চতুর্থ ওয়ারিশান পুরুষ; বিশিষ্ট অভিনেতা ও আবৃত্তিকার জয়ন্ত চট্রোপধ্যায় অধিকারী এবং তাঁর ছোট ভাই জ্যোতি চট্রোপধ্যায় অধিকারী সার্বজনীন এই মন্দিরটি তাঁদের পারিবারিক মন্দির হিসাবে দাবি করায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের এই শক্তিপীঠ স্থলে বহুতল ভবন বিশিষ্ট কমিউনিটি সেন্টার নির্মানের যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তা স্থিমিত হয়ে রয়েছে। শ্যামনগরের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা অভিযোগ করেছেন যে, মন্দিরটির চার পুরুষ পূর্বের চার সেবায়েত এর মধ্যে তিন সেবায়েত বহু পূর্বেই দেশ ত্যাগ করেছেন। এই তিন সেবায়েতের কোন ওয়ারিশান এদেশে নেই। সেই সুযোগে চতুর্থ সেবায়েত “জ্ঞান চট্রোপধ্যায় অধিকারী” এবং তাঁর পরবর্তী ওয়ারিশানগন মন্দিরের ১ হাজার ৬’শ ২ বিঘা জমি পুরুষানুক্রমে ভোগদখলে নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। তাঁরা এই জমি যুগে যুগে পুরুষানুক্রমে বিক্রি করেছেন। এমনকি মন্দির বাউন্ডারির মধ্যে বর্তমানে বিদ্যমান ৪৪ শতক জমির মধ্যে মাত্র ৭ শতক জমি মন্দিরের নামে রেকর্ড রয়েছে। ফলে জেলার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে।

Share