জাফর ইকবালের উদাসীনতা একদিন ববিতাকেও পেয়ে বসে

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো/ আমি তো এখন আর নই কারো’, ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী/ হয়ে কারো ঘরনী/ জেনে রাখো প্রাসাদেরও বন্দিনী প্রেম কভু মরেনি’, ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন/ দুজন দুজনার কত যে আপন/ কেউ জানে না’- গানগুলো কোথাও শুনলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে একজন মানুষের চেহারা। শুধু চেহার নয়, মনে পড়ে চিরসবুজ কথাটি- জাফর ইকবাল। আমাদের কালের নায়ক। আমাদের চলচ্চিত্রের সব চেয়ে দাপুটে নায়ক ছিলেন জাফর ইকবাল।

গায়ে সাদা টি-শার্ট আর সাদা প্যান্ট, পায়ে সাদা জুতা। এই সাদাকালো সাদামাটা পোশাকে কী অপরূপ ফুটে উঠত। তারুণ্যের প্রতীক, সিনেমায় চলচ্চিত্রে চিরসবুজের প্রতিভূ যেন নায়ক-গায়ক জাফর ইকবাল। ওই সময়ের নায়কদের মধ্যে সবচেয়ে ফ্যাশনেবল ও স্টাইলিশ ছিলেন শাহনাজ রহমতুল্লাহর আদরের এই ভাইটি। জাফর ইকবাল যখন যার সঙ্গে জুটিবদ্ধ হয়ে অভিনয় করেছেন সেখানেই যেন সোনা ফলেছে। বেকার যুবক, শিক্ষিত যুবক, মাস্তান, ভিক্ষারি, কণ্ঠশিল্পী, পুলিশ অফিসার, ডাক্তার, প্রেমিক- সব চরিত্রে অবলীলায় মিশে যাওয়ার যোগ্যতা তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়েছিল। ১৯৫০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন জাফর ইকবাল। গানকে ভালোবেসে গাইতে শুরু করেন। গিটার বাজানোয় আলাদা দক্ষতা ছিল তার। সেই সময়কার বিখ্যাত গায়ক এলভিস প্রিসলির ভক্ত ছিলেন তিনি। গানের প্রতি ভালোবাসা থেকেই ১৯৬৭ সালে বন্ধু তোতা, মাহমুদ ও ফারুককে নিয়ে গঠন করেছিলেন ব্যান্ড দল র‌্যাম্বলিং স্টোনস। অভিনয়ের পাশাপাশি তার গানেরও ভক্ত ছিলাম। ‘মামাভাগ্নে’ ছবিতে তার সহশিল্পী হিসেবে কাজের সুযোগ পেলাম। সালটা ভুলে গেছি। পছন্দের শিল্পীর সঙ্গে কাজ করব- এ নিয়ে একটু-আধটু ভয়ও ছিল। কিন্তু তার সহযোগিতায় সে ভয় কেটে যায়।

কাজের ব্যাপারে আমাকে অনেক সহযোগিতা করেন জাফর ইকবাল। ‘মামাভাগ্নে’ মুক্তির আগেই আমাদের দু’জনকে নিয়ে আরও চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছে প্রকাশ করেন পরিচালকরা।

কাজ করতে গিয়ে এই মানুষটির সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। ‘মামাভাগ্নে’ ছবির শুটিংয়ের সময় প্রায়ই তাকে দেখেছি গিটার বাজিয়ে গান গাইতে। দারুণ গিটার বাজাতেন। কণ্ঠও ছিল চমৎকার। তার গান শুনে একদিন গান শেখার কথা তাকে বলি। তিনিও আমাকে গানের তালিম দেওয়া শুরু করেন। গিটার বাজিয়ে ইংরেজি গান গেয়ে শোনাতেন।

অভিনয়ের সুবাদে মানুষটিকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। তার খাম-খেয়ালিপনা, উদাসীনতা একদিন আমাকেও পেয়ে বসে।

আমাদের জুটির প্রথম ছবি মুক্তির পর দর্শকমহলে দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীকালে আমরা ‘এক মুঠো ভাত’, ‘হারজিৎ’, ‘আপন পর’, ‘অবুঝ হৃদয়’সহ ত্রিশটির মতো ছবিতে অভিনয় করেছি। সব ছবি তখন হিট হয়।

জাফর ইকবালের আরও একটা গুণ ছিল। তিনি মানুষ হাসাতে পারতেন। শুটিংয়ে কারও খুব মন খারাপ বা কাউকে মুখ গোমড়া করে বসে থাকতে দেখলে, তার মন ভালো করার দায়িত্ব নিতেন জাফর ইকবাল। কারও মন খারাপ থাকলে আমরা তাকে দেখিয়ে দিতাম। ওই মানুষটির সামনে নানান হাসির গল্প বা মজার সব কর্মকাণ্ড করে বসতেন জাফর ইকবাল, যা দেখে মুহূর্তেই মন ভালো হয়ে যেত। সব সময় হাসি-খুশি থাকতে পছন্দ করতেন জাফর ইকবাল। তাই অন্যদেরও তিনি হাসিমুখে রাখতে চাইতেন। শুটিংয়ের ফাঁকে নানা বিষয়ে আমরা অনেক মজা করেছি, যা এখনও মনে পড়ে।

মানুষ হিসেবে জাফর ইকবালের কোন তুলনা হয় না। যেমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, তেমনি পরোপকারী। অন্যের বিপদ-আপদে সব সময় এই মানুষটিকে পাশে থাকতে দেখেছি। তবে নিজের মধ্যে দুঃখ-কষ্ট সব সময় আড়াল করে গেছেন তিনি। তাকে দেখে কখনও বোঝা যায়নি, তিনি কষ্টে আছেন বা তার কোন সমস্যা আছে। মুখের কোণে সব সময় হাসি রেখেছেন। সবার সঙ্গে হেসেখেলে সময় কাটিয়েছেন। তাকে দেখে কখনও খুব বেশি চিন্তিত মনে হলে আমরা জিজ্ঞাসা করেছি, কী হয়েছে? উত্তরের শুরুতেই একটা হাসি দিয়ে বলে উঠতেন- ‘কই, কিছু না তো।’

জাফর ইকবাল ১৯৯২ সালের ৮ জানুয়ারি পরলোক গমন করেন। তার সেই চিরচেনা হাসিমাখা মুখখানি এখনও আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এমন মানুষ পৃথিবীতে বারবার আসে না। প্রয়াত নায়ক জাফর ইকবাল আজীবন বেঁচে থাকবেন তার কর্মগুণে।

Share