আমদানি-রপ্তানির আড়ালে মুদ্রা পাচার বন্ধে কঠোর তদারকির নির্দেশ

প্রতি মাসে পাচার হচ্ছে প্রায় ১৫০ কোটি ডলার

নয়াবার্ত‍া প্রতিবেদক : জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে দেশ থেকে মুদ্রা পাচার বন্ধে বড় অঙ্কের এলসির বিপরীতে সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কঠোর তদারকির নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সাথে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মাধ্যমেও তদারকি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অনলাইন ও অফলাইনে সফটওয়্যারের মাধ্যমে এবং সরেজমিনেও তদারকি করছে। প্রয়োজনে ব্যাংকগুলোতে বিশেষ পরিদর্শক দলও পাঠানো হচ্ছে। এতে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বেশ কিছু টাকা পাচারের ঘটনা ইতোমধ্যেই উদঘাটিতও হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগে এককভাবে আমদানি তদারকি করা হতো। এখন রপ্তানিতেও তদারকি করা হচ্ছে। যেসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, কি পরিমাণ পণ্য আমদানির এলসি খোলা হচ্ছে, এর বিপরীতে কী পরিমাণে দেনা শোধ করা হচ্ছে এবং যথাযথভাবে পণ্য দেশে আসছে কি না। যেসব এলসির নিষ্পত্তি হচ্ছে না সেগুলো শনাক্ত করে ব্যাংকগুলোকে দ্রুত আমদানিকারকের সঙ্গে কথা বলার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। আমদানি পণ্যের মূল্য সম্পর্কেও তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, আমদানির আড়ালে দেশ থেকে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১৫০ কোটি ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে। পাচার করা অর্থে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা কোম্পানি গঠন করে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। ওইসব ব্যবসার কোনো মুনাফা দেশে আসছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২৩ সালের মার্চে সর্বোচ্চ ৯৫১ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। এসব আমদানির একটি অংশ পাচার হচ্ছিল। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ৪৭৬ কোটি ডলারে নামিয়ে আনা হয়। এতে এলসি খোলার হার প্রায় অর্ধেক কমে। ফলে একদিকে ডলারের খরচ কমেছে, অন্যদিকে রিজার্ভ সাশ্রয় হয়েছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, যে পরিমাণে পণ্য রপ্তানি হচ্ছে ওই পরিমাণে আয় দেশে আসছে না। ডলার বাজার অস্থির হওয়ায় বেশি দাম পাওয়ার আশায় কিছু রপ্তানিকারক ডলার বিদেশে রেখে দিচ্ছেন। নানা অজুহাতে সেগুলো দেশে আনা থেকে বিরত থাকছেন। যে কারণে বাজারে ডলারের প্রবাহ কমেছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরে ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে সমুদয় অর্থ দেশে আসেনি। বর্তমানে রপ্তানি মূল্যের ৯ বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন দেশে আটকে রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু অর্থ ‘ডেফার্ড’ অর্থাৎ বৈদেশিক ক্রেতারা মূল্য পরিশোধের সময় বাড়িয়ে নিয়েছে। তবে ডেফার্ডের পরিমাণ কত বিলিয়ন ডলার তা জানা যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক অক্টোবরের মধ্যে আটকা থাকা রপ্তানি আয় দেশে ফেরত আনার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়। এই নির্দেশনা কত টুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তা জানা যাবে চলতি নভেম্বর শেষে। রপ্তানির বিপরীতে সমুদয় আয় দেশে না আসায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ইপিবির রপ্তানি আয়ের হিসাবের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে। ইপিবি হিসাব করে পণ্য জাহাজীকরণের ভিত্তিতে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাব করে ডলার দেশের আসার ভিত্তিতে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবটিই প্রকৃত রপ্তানি আয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে প্রায় ১৫০ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় যথাসময়ে দেশে আসেনি। এগুলো দেশে আনার জন্য ব্যাংকগুলোকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংক সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারকের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এখন কি পরিমাণে পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। আয় আসছে কত। বাকি আয় কেন আসেনি এগুলো পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বৈদেশিক মন্দার কারণে কিছু রপ্তানি আয় দেশে আসছে না। এছাড়া কিছু আয় রপ্তানিকারক বিদেশে ধরে রাখছেন। ওইসব রপ্তানি আয় দেশে আনার জন্য গত মার্চে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনা দিয়েছিল যে তারিখের মধ্যে রপ্তানি আয় দেশে আনার কথা ওই তারিখের মধ্যে না এনে পরে আনলেও তা বকেয়া আয় হিসাবে গণ্য হবে। যে তারিখে বকেয়া হবে ওই তারিখের বিনিময় হারে রপ্তানিকারক টাকা পাবেন। অর্থাৎ পণ্য রপ্তানির চার মাসের মধ্যে তা দেশে আনার কথা। এর মধ্যে না এলে তা বকেয়া হবে। এমন বকেয়া রপ্তানি আয় দেশে আনার ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকদের উৎসাহিত করতে সম্প্রতি আগের নীতিমালায় পরিবর্তন এনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী বকেয়া রপ্তানি আয় যে তারিখে দেশে আসবে ওই দিনের বিনিময় হারে রপ্তানিকারক অর্থ পাবেন। ফলে রপ্তানিকারকরা আগের বকেয়া আয় দেশে আনলেও এখন ডলারের বাড়তি দাম পাচ্ছেন। এছাড়া রপ্তানি আয়ের বিপরীতে নির্ধারিত সরকারি খাতের প্রণোদনার টাকাও দ্রুত পরিশোধ করা হচ্ছে। ফলে বকেয়া রপ্তানি আয় দেশে আনার প্রবণতা বেড়েছে। একই সঙ্গে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে এর বিপরীতেও নগদ প্রণোদনা দ্রুত পরিশোধ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও প্রণোদনা দিচ্ছে। এছাড়া ব্যাংকগুলো বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে বাড়তি দামে রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। বর্তমানে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। এর সঙ্গে সরকারি খাতের প্রণোদনা আড়াই শতাংশ ও ব্যাংকগুলোর নিজস্ব প্রণোদনা আড়াই শতাংশ। এ দুটো মিলে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া যাবে। প্রণোদনাসহ প্রতি ডলারের দাম হবে সর্বোচ্চ ১১৬ টাকা। অর্থাৎ ১১৬ টাকা প্রবাসীদের দেওয়া যাবে। এর মধ্যে এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোকে কী পরিমাণ অর্থ দেবে বা কমিশন দেবে তা নির্ধারণ করবে ব্যাংকগুলো। কিন্তু বর্তমানে অনেক ব্যাংক ১২২ থেকে ১২৭ টাকা দামেও রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। এই দামে অনেক ব্যাংক আগাম আদেশও দিয়ে রেখেছেন বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোতে। ফলে এখনও বাড়তি দামেই রেমিট্যান্স কিনছে অনেক ব্যাংক। এর মধ্যে সরকারি প্রণোদনা বাবদ ২ টাকা ৭৫ পয়সা, এটিসহ ব্যাংক দেবে ১১৩ টাকা ২৫ পয়সা। এর সঙ্গে প্রণোদনা বাবদ ব্যাংক আরও দিতে পারবে ২ টাকা ৭৫ পয়সা। এ দুটো মিলে ১১৬ টাকা দেওয়া যাবে প্রতি রেমিট্যান্স। কিন্তু ব্যাংক এর চেয়েও বেশি দিচ্ছে ৬ থেকে ১১ টাকা। এই বাড়তি অর্থ ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব তহবিল থেকে সমন্বয় করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মৌখিকভাবে বলেছে, রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহের ক্ষেত্রে শিথিলতা আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখাবে। এরপর পর শিথিলতা থাকবে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে আগামী ডিসেম্বরের শেষ দিকে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি বাবদ ৬৮ কোটি ডলার পাওয়া যাবে। এর সঙ্গে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য সংস্থা থেকে আরও প্রায় ৬০ কোটি ডলার মিলবে। এ দুটো মিলে ১৩০ কোটি ডলার পাওয়া যাবে। এছাড়া জ্বালানি তেল আমদানিতে সৌদি আরব থেকে ২০০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে। ভারত থেকেও ২০০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়ার উদ্যোগ চলছে। এছাড়া রিজার্ভ সংকট কাটাতে বাংলাদেশকে চীনও সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ কারণে চীন থেকে যেসব পণ্য আমদানি করা হয় তার একটি অংশ নগদ আকারে না এনে চীনা ঋণের মাধ্যমে আমদানি করা হবে। এ জন্য চীনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। এর বাইরে পাইপ লাইনে আটকে থাকা অর্থও ছাড় করানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বৈশ্বিক সংকটে গত দুই বছর ধরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ বেড়ে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলারে উঠেছিল। এরপর থেকে কমছে। এখন তা কমে ১ হাজার ৯৭৬ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।

Share