নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থাকলেও বাঁচার জন্য চিকিৎসার অজুহাতে বিদেশ যেতে চান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। তবে গোয়েন্দা সূত্র বলছে, সম্রাট তাদের নজরদারিতে রয়েছেন। তাকে গ্রেফতারের জন্য তারা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষায় রয়েছে। অস্ত্র ও মাদকের পৃথক দুই মামলায় সাত দিনের রিমান্ডে থাকা যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে স্বীকার করেছেন, মতিঝিল এলাকায় অবস্থিত ছয়টি ক্লাবে ক্যাসিনো, জুয়ার আসর ও অশ্লীলতার নিয়ন্ত্রক ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান অভিযানের মুখে গ্রেফতার এড়াতে সম্রাট বিদেশ চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমন আলোচনা থাকলেও তার ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, সম্রাটের হার্টে পেসমেকার বসানো রয়েছে। এ জন্য তিনি মাঝেমধ্যেই বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা করান। শিগগির বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল। তার জরুরি চিকিৎসারও দরকার।
সূত্র জানায়, যুবলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী একটি মহল সম্রাটকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। গত বুধবার অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে র্যাবের হাতে আটক হন ঢাকা দক্ষিণ মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া। অস্ত্র ও মাদকের পৃথক দুই মামলায় তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। খালেদকে গ্রেফতার করা হলেও তার গুরু হিসেবে খ্যাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন সম্রাট। খালেদকে বুধবার রাতভর জিজ্ঞাসাবাদ করেন র্যাব সদস্যরা।
সূত্র জানায়, ঢাকায় ক্যাসিনো বিস্তার লাভ করে ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাটের ছত্রছায়ায়। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তার অধীন ক্যাসিনোর সংখ্যা ১৫টিরও বেশি। আর এসব ক্যাসিনো থেকে প্রতিরাতে তার পকেটে ঢোকে ৪০ লাখ টাকারও বেশি। ঢাকায় ক্যাসিনোর বিস্তার ঘটায় নেপালি নাগরিক দীনেশ ও রাজকুমার। সম্রাটের তত্ত্বাবধানে এরা একের পর এক ক্যাসিনো খুলে বসে ঢাকা শহরে। এসব ক্যাসিনোতে কর্মরত নেপালিদের হাত ধরে কোটি কোটি টাকা নেপালেও পাচার হয়েছে।
শুধু মতিঝিলেই ছয়টি ক্লাব রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সভাপতি স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাউছার; আরামবাগ ও দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর একে মমিনুল হক সাঈদ, ভিক্টোরিয়া ক্লাবের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট এবং ইয়ংমেন্সের সভাপতি খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া।
সম্রাট ও খালেদ দুটি ক্লাবের সভাপতি হলেও দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ওই ছয়টি ক্লাবের প্রতিটি জুয়ার আসর সম্রাট ও খালেদের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় চলত। এ ছাড়া দৈনিক তারা দুজন জুয়ার আসর থেকে চাঁদা উত্তোলন করতেন।
রিমান্ডে থাকা খালেদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কয়েকটি ক্যাসিনোর ‘নিয়ন্ত্রক’ হিসেবে ঢাকা দক্ষিণের যুবলীগ সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের নাম বলেছেন। তবে সম্রাট নিজে সরাসরি ক্যাসিনো দেখাশোনা করতেন না। তার ক্যাসিনো চালাতেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওসার ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর একেএম মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। তারাই এক বছর আগে পল্টনের প্রীতম-জামান টাওয়ারে ক্যাসিনো চালু করেন। পরে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। ক্যাসিনোর দুই হোতা আবু কাওসার ও মমিনুল হক এখন বিদেশে রয়েছেন।
যুগলীগের ক্যাসিনো খালেদকে গ্রেফতারের পর সম্রাট গত বুধবার থেকে নিজের কার্যালয়েই অবস্থান করছেন। ওইদিন রাতে তিনি সহস্রাধিক নেতাকর্মী নিয়ে তার কার্যালয়ে অবস্থান নেন। এখন পর্যন্ত তিনি কার্যালয় থেকে বের হননি। জানা গেছে, ৩০০ লোকের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা ভেতরে করা হয়। ভবনটির চারতলায় নিজের কার্যালয়ে তিনি রয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা জানান, সম্রাট যুবলীগের প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। ২০১৬ সালের দিকে ঢাকায় তার ক্যাসিনো কালচার শুরুর ঘটনা সবার জানা। কিন্তু নগদ অর্থের লোভে সবাই এতদিন মুখ খোলেননি। যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে সম্রাট অর্থ ও লোকজন দিয়ে সহযোগিতা করতেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো জানায়, ইসমাইল হোসেন সম্রাট সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতেন ৩টি ক্যাসিনো। এগুলো হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, ব্রাদার্স ক্লাব ও বনানী এলাকার গোল্ডেন ঢাকা। এ ছাড়া মতিঝিল এলাকার ফুটবল ক্লাব, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব, সোনালী অতীত, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্লাব ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের নিয়ন্ত্রণ ছিল সম্রাটের হাতে। ওই ক্লাবগুলো মতিঝিল থানার এক কিলোমিটারের মধ্যে। স্থানীয় কতিপয় যুবলীগ নেতার মাধ্যমে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হতো।
ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের হয়ে ক্যাসিনো থেকে টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া দেখাশোনা করেন ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, মতিঝিল এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইদ, সহ-সভাপতি সোহরাব হোসেন স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক গাজী সরোয়ার হোসেন বাবু, সাংগঠনিক সম্পাদক জামাল, সাংগঠনিক সম্পাদক মাকসুদ, সহ-সভাপতি মুরসালিন, মনির হোসেন, মনা ও রানা। যুবনেতাদের হয়ে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন টেন্ডার শফি বা শিবির শফি এবং বিআইডব্লিউটিএ’র টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন মনির হোসেন।
২০১৮ সালের শেষদিকে সিঙ্গাপুরে ইসমাইল হোসেন সম্রাটের চীনা বান্ধবী সিন্ডি লির জন্মদিনে বড় আকারের একটি পার্টির আয়োজন করেন সম্রাট। জাঁকজমকপূর্ণ ওই পার্টিতে যোগ দিতে সিঙ্গাপুরে যান সম্রাটের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত যুবলীগ দক্ষিণের সহসভাপতি আরমান, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল হক সাঈদ, শেখ সোহেল ও সাবেক এক প্রতিমন্ত্রীর এপিএস মিজানুর রহমান।
ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের গ্রেফতারের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, অপরাধ প্রমাণিত হলে শুধু সম্রাট নয়, কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।