নিজস্ব ডেস্ক প্রতিবেদক : সিঙ্গাপুরের প্রবাসী বাংলাদেশি আলী আজম ফোনে বলছিলেন, তাদের সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। গোটা সিঙ্গাপুরই কর্মব্যস্ত ছিল। কিন্তু চলতি মাসের শুরুর দিকে নতুন করে করোনা আতঙ্ক ছড়াতে থাকে। প্রতিদিনই বাংলাদেশি প্রবাসীরা আক্রান্ত হওয়ায় আতঙ্কটা পুরো বাংলাদেশি কমিউনিটিতেই ছড়িয়ে পড়েছে।
১০ বছর ধরে সিঙ্গাপুরের তিয়াং বারু শহরে বসবাসকারী আলী আজম একটি কোম্পানিতে তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগে কর্মরত। তিনি বলেন, সরকার এখন পুরো দেশই লকডাউন করে দিয়েছে। সরকারি নিয়ম মেনে বাসায় রয়েছেন তারা।
অরেক প্রবাসী সিকদার খালেক এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সিঙ্গাপুরে বসবাস করছেন। তিনি বলছিলেন, যারা আবাসিক ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন, তাদের মধ্যে করোনাভাইরাস সেভাবে ছড়াতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশি কমিউনিটি অধ্যুষিত হোস্টেল ও ডরমিটরিতে এ ভাইরাসটি ছড়িয়ে গেছে। হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক থাকেন এসব হোস্টেল ও ডরমিটরিতে।
সিকদার খালেক আরও জানান, সিঙ্গাপুরের সরকার শ্রমিকবান্ধব। হোস্টেলগুলো পুরোপুরি লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে। তবে সরকারিভাবেই সেখানে প্রতিদিন তিন বেলা খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। কর্মব্যস্ত পুরো শহরটি এখন ফাঁকা। মার্কেটগুলোও বন্ধ।
মোহাম্মদ রাসেল নামে অপর এক প্রবাসী বলছিলেন, প্রবাসে যেমন তারা উদ্বেগ আর শঙ্কা নিয়ে বসবাস করছেন, তেমনি বাংলাদেশের স্বজনদের নিয়েও তারা সব সময় শঙ্কায় থাকেন। দুশ্চিন্তায় তাদের ঘুম পর্যন্ত হারাম হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, তার ২০ বছরের সিঙ্গাপুর জীবনে এরকম পিনপতন নীরবতা দেখেননি। কোনো কোলাহল নেই, কর্মব্যস্ত শহর যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। কোথাও কোনো মানুষ নেই। বন্ধের দিনে বাংলাদেশিদের আড্ডাও নেই। কেমন যেন একটা ভুতড়ে অবস্থা বিরাজ করছে। তবে সিঙ্গাপুর সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ সব সময় তাদের খোঁজ রাখছে।
সিঙ্গাপুরের এই প্রবাসীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে মনে হয়েছে, প্রাণঘাতী করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় শুরুর দিকে সিঙ্গাপুর রীতিমতো আদর্শ হয়ে উঠেছিল। চমৎকার ব্যবস্থাপনায় শুরুর দিকে বৈশ্বিক মহামারির এ ধাক্কা ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছিল দেশটি। এতে জীবনযাত্রাও স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। হঠাৎ করে চলতি মাসের একেবারে শুরুর দিকে নতুন করে করোনার ধাক্কা লাগে, যাতে আগামী ৪ মে পর্যন্ত দেশটির সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিঙ্গাপুরে দুই লাখের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছেন, যাদের বেশির ভাগই হোস্টেলে থাকেন। এসব হোস্টেলই করোনার ক্লাস্টার হিসেবে চিহ্নিত করেছে দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ। এতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে স্বাস্থ্যগত শঙ্কা ছাড়াও তারা বেতন পাবেন কিনা, চাকরি থাকবে কিনা- এমন শঙ্কাও দেখা দিয়েছে বলে বেশ কয়েকজন শ্রমিক জানালেন।
অবশ্য শ্রমিকদের চাকরি বা বেতন নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. মোস্তাফিজুর রহমান। গত ১০ এপ্রিল হাইকমিশনের নিজস্ব ফেসবুক পেইজে এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। সিঙ্গাপুর সরকারও উদ্বিগ্ন। অবশ্য ইতোমধ্যে দেশটির সরকার বেশকিছু ব্যবস্থাও নিয়েছে। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশি কর্মীদের সার্বিক অবস্থা নিয়ে হাইকমিশন সিঙ্গাপুরের সরকারের বিভিন্ন মহলের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে। সিঙ্গাপুর সরকার বলেছে, কর্মীরা নিয়মিত বেতন পাবেন, দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। খাবারও প্রয়োজনে রুমে রুমে সরকার পৌঁছে দেবে। এ ছাড়া সরকার সবার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি প্রবাসী শ্রমিকদের জন্যও প্রযোজ্য।
হাইকমিশনার সব বাংলাদেশি কর্মীকে সিঙ্গাপুর সরকারের দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলারও আহ্বান জানান।
অবশ্য বেশ কয়েকজন প্রবাসী বলেছেন, তারা সরকারের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। এরপরও প্রতিদিন বাংলাদেশিদের আক্রান্তের খবর তাদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে। প্রায় প্রতিদিনই আক্রান্তের হারও বাড়ছে। গত ৪ এপ্রিল ২৮ বাংলাদেশি শ্রমিকের আক্রান্ত হওয়ার খবর দেয় দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ। পরদিন সে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৪৩ জনে, ৬ এপ্রিল তা কিছুটা কমে ২৫ জন হলেও পরদিন তা বেড়ে হয় ৪৭ জন। ৮ এপ্রিল ৫৫ জন, ৯ এপ্রিল ১১৬ জন, ১০ এপ্রিল ৮৫ জন এবং সর্বশেষ ১১ এপ্রিল তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০২ জনে।
সিঙ্গাপুরে বসবাসরত শ্রমিক ও হাইকমিশন সূত্র জানায়, চুয়াচুকাং ডরমিটরি, পঙ্গুল, জুরংইস্ট, তুগান, পিঞ্জরি, টেস্টানিজ ডরমিটরিসহ অন্তত ৪৫টি ডরমিটরিতে বাংলাদেশি কর্মীসহ অন্যান্য দেশের কর্মীরা থাকেন। দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ এসব ডরমিটরিকে করোনার হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সেখানে বসবাসরত বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি প্রবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা একটি কক্ষে ১০ থেকে ২০ জন করে থাকেন। কোনো কোনো কক্ষে দোতলা ও তিনস্তরে থাকার বিছানাও রয়েছে। ফলে প্রবাসী শ্রমিকরা বেশি করে আক্রান্ত হচ্ছেন।