অকালেই শেষ ‘তেরে নাম’ খ্যাত নায়িকার ক্যারিয়ার

নিজস্ব ডেস্ক প্রতিবেদক : তখন ইন্ডাস্ট্রিতে মল্লিকা শেরওয়াত, বিপাশা বাসুর মতো সাহসী নায়িকাদের রমরমা অবস্থা চলছিলো। ঠিক সেসময়েই এইসব নায়িকাদের মাঝে ‘গার্ল নেক্সট ডোর’ হয়ে এসে দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছিলেন ভূমিকা চাওলা। সালমান খানের খারাপ সময়টাতে ভূমিকা তার নায়িকা হয়েছিলেন। এতসব নায়িকাদের ভীড়ে ‘তেরে নাম’ ছবির নায়িকা ভূমিকা চাওলার পরিচয় হয়ে গেল ‘ওয়ান ফিল্ম ওয়ান্ডার’।

ভূমিকার জন্ম ১৯৭৮ সালের ২১ আগস্ট, দিল্লিতে। জন্মগত নাম, রচনা। বাবা সেনাবাহিনীর আধিকারিক হওয়ায় তাদের তিন ভাইবোনের শৈশব কেটেছে কড়া নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে। কলেজে পড়ার সময় থেকে অল্পবিস্তর মডেলিং শুরু করেন ভূমিকা। তবে তার পরিবার মডেলিং বা অভিনয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন। ভূমিকার জনপ্রিয়তা দেখে পরে তার পরিবার হার মানতে বাধ্য হয়।

১৯৯৭ সালে কাজের সূত্রে মুম্বাই চলে আসেন ভূমিকা। কাজ শুরু করেন মিউজিক ভিডিওতে। পাশাপাশি বিজ্ঞাপনেও তাকে দেখা যায় সেসময়। প্রথম ছবিতে অভিনয় ২০০০ সালে, তেলেগু ছবিতে। পরের বছর তার তেলুগু ছবি ‘খুশি’ সুপারহিট হয়। জনপ্রিয়তার সুবাদে দু’বছরের মধ্যে দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রিতে অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন ভূমিকা। এরপর তার কাছে সুযোগ আসে বলিউড থেকেও। ২০০৩ সালে মুক্তি পায় ভূমিকার প্রথম হিন্দি ছবি ‘তেরে নাম’।

তখন সদ্য সদ্য ভেঙে গিয়েছে সালমান-ঐশ্বরিয়ার প্রেমের সম্পর্ক। প্রেমে ধাক্কা খেয়ে ভাইজান তখন বিধ্বস্ত। ইন্ডাস্ট্রির অনেকের সঙ্গেই তার দূরত্ব বেড়ে গিয়েছে অভব্য আচরণের কারণে। বলা হয়, ‘তেরে নাম’ ছবির গল্প আদতে সালমান-ঐশ্বরিয়ার প্রেম নিয়েই লেখা হয়েছে। সতীশ কৌশিকের পরিচালনায় ‘তেরে নাম’ ছবিটি সুপারহিট হয়। এই ছবি সালমানকে ‘ব্যাড বয়’ পরিচয় থেকে বেরিয়ে আসতেও সাহায্য করেছিল। সে সময় আলোচনা উঠেছিল, সালমানের ক্যারিয়ার নাকি ভাঙনের মুখে। সেই আলোচনার মুখেও যোগ্য জবাব দেয় ‘তেরে নাম’ এর সাফল্য।

অন্য দিকে, এই ছবির সুবাদে ভূমিকা দর্শকদের পাশাপাশি বলিউডের হৃদয়ও জয় করে নেন। ২০০৪-এ অভিষেক বচ্চনের সঙ্গে ভূমিকার ছবি ‘রান’ সফল হয়নি। তবে ছবির কমেডি সিকোয়েন্স বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। সে সময় সালমান একটি ছবিতে ভূমিকাকে অভিনয়ের জন্য বলেন। ছবির নাম ছিল ‘দিল নে জিসে আপনা কাহা’। এই ছবিতে সালমান, ভূমিকা ছাড়াও ছিলেন প্রীতি জিনতা। কিন্তু ছবিটি ফ্লপ হয়। পর পর তিনটি ছবিতে ভূমিকা অভিনীত চরিত্র ছিল একই রকমের। গ্ল্যামার থেকে দূরে, পাশের বাড়ির মেয়ের মতো। ফলে বলিউডে টাইপকাস্ট হয়ে যেতে থাকেন তিনি।

এরপর ২০০৫ সালে ‘সিলসিলে’ ছবিতে নিজের ইমেজ ভাঙার চেষ্টা করেন ভূমিকা। কিন্তু সেই ছবিও মুখ থুবড়ে পড়ে। পর পর ছবি ব্যর্থ হলেও ভূমিকার কাছে বড় ছবির অফার আসা বন্ধ হয়নি। ‘দিল যো ভি কাহে’ ছবিতে তিনি অভিনয় করেন অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে। কিন্তু বলিউডের মূল স্রোতে আর ফিরে আসতে পারেননি ভূমিকা। প্রথম দিকের দুরন্ত সাফল্যের সঙ্গে নিজের ক্যারিয়ারের এই চেহারা তিনি মেলাতে পারছিলেন না। ফলে ক্রমশ অবসাদ ও হতাশার শিকার হয়ে পড়ছিলেন। অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে যোগাভ্যাস শুরু করেন ভূমিকা। সালমান, মাধুরীর মতো তারকা যার কাছে যোগচর্চা করতেন, সেই ভারত ঠাকুরের দ্বারস্থ হন ভূমিকা। ভারতের সান্নিধ্য তার জীবনে আমূল পরিবর্তন আনে। কিছু দিনের মধ্যেই ভারতের প্রেমে পড়েন ভূমিকা।

প্রেমের কথা প্রথম থেকেই স্বীকার করলেও বিয়ে নিয়ে তখনও পরিকল্পনা ছিল না। নিজের ক্যারিয়ার বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন ভূমিকা। কিন্তু ‘ফ্যামিলি’ বা ‘গাঁধী মাই ফাদার’ ছবিতে অভিনয় করেও তার ক্যারিয়ারের কোনও পরিবর্তন হয়নি। তার পরেও বড় ছবির অফার পান ভূমিকা। ইমতিয়াজ আলি তাকে ও ববি দেওলকে নিয়ে ‘জাব উই মেট’ ছবি করবেন বলে ঠিক করেন। ভূমিকা ভেবেছিলেন এই ছবি দিয়েই তিনি বলিউডে সেকেন্ড ইনিংস শুরু করবেন। কিন্তু পরে প্রযোজকের চাপে ইমতিয়াজ বাধ্য হন নায়ক-নায়িকা পাল্টে ফেলতে। ববি দেওল ও ভূমিকা চাওলার বদলে আসেন কারিনা ও শহিদ কাপুর। সুপারডুপার এই হিট ছবিটি হাতছাড়া হয়ে যায় ভূমিকার।

এর পরই হতাশ হয়ে ভূমিকা বলিউড ছেড়ে দেন। ভারত কুমারকে বিয়ের পরে তিনি হায়দরাবাদে চলে যান। সেখানে দু’জনে প্রযোজনা সংস্থা শুরু করেন। ভূমিকা অভিনয় করতে থাকেন শুধুমাত্র দক্ষিণী ছবিতেই। পাশাপাশি ‘মায়ানগর’ নামে একটি পত্রিকাও শুরু করেন। প্রযোজনা সংস্থা থেকে একটি ছবিও প্রযোজনা করেন। কিন্তু সেটি সুপারফ্লপ হয়। মুখ থুবড়ে পড়ে পত্রিকাটিও। এই দু’টি ঘটনায় কয়েক কোটি টাকা লোকসান হয়। পরে ভূমিকা জানিয়েছিলেন, স্বামী ও কিছু বন্ধুর কথায় তিনি ছবি প্রযোজনা করেছিলেন। যা তার ক্যারিয়ারে বড় ভুল ছিল। এর পর ভূমিকা ঠিক করেন তিনি শুধু অভিনয়ই করবেন। দক্ষিণী ছবির ইন্ডাস্ট্রিতেই মন দেন তিনি।

কয়েক বছর পরে ভূমিকার টাকা আবার ব্যবসায় নিয়োগ করেন ভারত ঠাকুর। তিনি দুবাইয়ে যোগচর্চার কেন্দ্র শুরু করেন। ভারত ঠাকুরের নতুন ব্যবসা সফল হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে সমস্যা দেখা দেয়। গুঞ্জন ওঠে, তিনি দুবাইয়ে নিজের হাই প্রোফাইল ক্লায়েন্টের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত। গুঞ্জন ক্রমে গাঢ় হওয়ায় ভূমিকাও দুবাইয়ে থাকতে চলে যান। কিন্তু স্ত্রীর কাছে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন ভারত ঠাকুর। কিন্তু ভূমিকা তার কথা বিশ্বাস করেননি। তাদের দাম্পত্য অশান্তি মাঝে মাঝেই চলে আসত ফিল্মি গুঞ্জনে।

২০১১ সালে এমনও শোনা যায়, বিবাহ বিচ্ছেদ চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন ভূমিকা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের মধ্যে সব সমস্যা দূর করে ফেলেন ভারত ও ভূমিকা। দুবাইয়ে ব্যবসার পাট চুকিয়ে চলে আসেন মুম্বাইতে। পরে দাম্পত্যে ফাটলের কথা অস্বীকার করে নেন ভূমিকা। ২০১৪ সালে তাঁদের কোলজুড়ে আসে পুত্র সন্তান। এর পর সংসার এবং ক্যারিয়ারই ভূমিকার কাছে পাখির চোখ হয়ে ওঠে। দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রিতে তো তিনি পরিচিতি ছিলেনই।

তিনি আবার বলিউডে ফিরে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু ২০০৩ ও ২০১৪-র মধ্যে সবদিক দিয়েই বিস্তর ব্যবধান ছিল। ভূমিকা জানতেন তিনি আর নায়িকা হতে পারবেন না। তিনি এরপর অভিনয় করেন ‘এম এস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’-তে। সেখানে তিনি সুশান্ত সিং রাজপুতের বড় বোনের চরিত্রে হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু দর্শকদের কাছে তার এই কামব্যাক বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। বরং বলিউডের তুলনায় ভূমিকা অনেক বেশি জনপ্রিয়তা ও পরিচিতি পেয়েছেন দক্ষিণে। হিন্দি ছবিতে তাকে বিশেষভাবে দেখা না গেলেও তামিল ও তেলেগু ছবিতে এখনও নিয়মিত মুখ ‘তেরে নাম’ খ্যাত এই নায়িকা। ভারত ও ভূমিকার দাম্পত্যও সব ঝড় কাটিয়ে উঠেছে বলে শোনা যাচ্ছে। নতুন করে বিদেশে যোগচর্চার কেন্দ্র শুরু করেছেন ভরত ঠাকুর। ভূমিকাও উপভোগ করছেন জীবনের নতুন পর্ব।

Share