অর্থঋণ আদালতে আটকা ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : অর্থঋণ আদালতে আটকা পড়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। একদিকে বাড়ছে খেলাপি ঋণ, অন্যদিকে অর্থঋণ আদালতের মামলা। কিন্তু ব্যাংকের স্থিতিপত্র থেকে বাদ পড়া এসব অর্থ আদায়ে তেমন কোনো গতি নেই।

আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে খেলাপি ঋণ আদায়ে মামলা বাড়লেও নিষ্পত্তি হচ্ছে খুবই কম। ২০২২ শেষে অর্থঋণ আদালতে ৭২ হাজার ১৮৯টি বিচারাধীন মামলার বিপরীতে আটকে আছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা।

ছয় মাস আগে অর্থাৎ গত বছরের জুন শেষে যা ছিল ৬৯ হাজার ৩৬৯টি মামলার বিপরীতে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এ সময়ে মামলা এবং আটকে থাকা টাকার অঙ্ক-উভয়ই বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) অর্থঋণ আদালতে দায়ের করা অনিষ্পন্ন মামলায় ব্যাংকের দাবীকৃত টাকার অঙ্ক বেড়েছে ১৯ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। একই সময়ে মামলা বেড়েছে ৮ হাজার ৩৪৪টি। কিন্তু পুরো এক বছরে (২০২২) মামলা বেড়েছে ১৪ হাজার ৪৫২টি এবং দাবীকৃত অঙ্ক বেড়েছে ৩৫ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সাল শেষে অর্থঋণ আদালতে বিভিন্ন ব্যাংকের করা মামলার স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার ৩৪৮টি। এর বিপরীতে দেশের বিভিন্ন ঋণখেলাপি থেকে ব্যাংকগুলোর পাওনা টাকার অঙ্ক ২ লাখ ৪৯ হাজার ১৮৪ কোটি। তবে এত টাকা দাবির বিপরীতে ছয় মাসে আদায়ের অঙ্ক অতি সামান্য। মাত্র ২১ হাজার ৮৩ কোটি টাকা।

বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ৪৩ হাজার ১৫৩ মামলার বিপরীতে ৮৮ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা আটকে আছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১৫ হাজার ৬০৪টি। এর বিপরীতে পাওনার পরিমাণ ৭১ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা।

ব্যাংকারদের মতে, আগে গ্রাহকের সক্ষমতা যাচাই-বাছাই করে ঋণ দিত বেসরকারি ব্যাংক। ফলে তাদের ঋণ আদায়ের হারও বেশি ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে সেটা কম দেখা যেত। কারণ, সরকারি ব্যাংকগুলোয় অনেক সময় ঋণ দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়। এসব ঋণ একসময় আদায় না হওয়ায় মন্দমানের খেলাপিতে পরিণত হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে উলটো চিত্র লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণ, এখন বেসরকারি ব্যাংকেরই মামলা দাবির পরিমাণ বেশি। ব্যাংকাররা আরও জানান, কুঋণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক পর্যায়ে আদায় হয় না।

আদালতে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো তাই অর্থঋণ আদালতসহ অন্যান্য আদালতে মামলা করে থাকে। কিন্তু আদালত পর্যাপ্ত না থাকায় মামলা নিষ্পত্তি হয় ধীরগতিতে। এভাবেই খেলাপি ঋণসংক্রান্ত মামলার পাহাড় জমতে থাকে।

এর কারণ হিসাবে দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বারবার ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেওয়ায় যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন, তারাও এখন নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয়ও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। আর ঋণ আদায়ের জন্য শেষ পর্যন্ত আদালতে মামলা করতে হচ্ছে। এতে একদিকে ব্যাংকের মামলা পরিচালনায় ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে সময়মতো মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় টাকা আটকে যাচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে ব্যাংকের ঋণ বিতরণের সক্ষমতা।

এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, পর্যাপ্ত সংখ্যক আদালত ও বিচারক সংকটের কারণে মামলাগুলো দীর্ঘদিন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকে।

আবার আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে নেন অনেক ঋণখেলাপি। ফলে অতিরিক্ত অর্থব্যয় হয় ব্যাংকের। পাশাপাশি নষ্ট হয় মূল্যবান সময়।

তিনি বলেন, খেলাপিদের বিরুদ্ধে দেশের আইনি কাঠামো অন্যান্য দেশের মতো শক্তিশালী নয়। যা আছে, সেই আইনি প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রভাবশালী শক্তি সক্রিয় বলে মনে করেন তিনি।

অর্থঋণবিষয়ক বিশ্লেষক অ্যাডভোকেট মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন বলেন, একটি নির্দিষ্ট সময় পর খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালত আইন অনুযায়ী মামলা করে ব্যাংক। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ মামলা দায়ের না হলে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট অফিসারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে আইনে।

তিনি আরও বলেন, ঢাকার বাইরে যেসব অর্থঋণ আদালত আছে, সেখানে অর্থঋণ মামলার বাইরেও অন্যান্য মামলাও চলে। এতে অর্থঋণ মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। এছাড়া ব্যাংকগুলোকেও মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আরও যত্নশীল হওয়ার পরামর্শ এ আইনজ্ঞের। ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যাতে নিয়মিত মামলার খোঁজ রাখেন, সেই পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থঋণ আদালতের এক আইনজীবী জানান, কিছু কিছু ব্যাংক মামলা করার পর আর খোঁজখবর রাখে না। বাদী ও আসামি উপস্থিত না থাকায় বছরের পর বছর ঘুরতে থাকে মামলা। পরিবর্তন হতেই থাকে শুনানির তারিখ।

২০ বছর ধরে মামলার খবর না রাখার নজির পাওয়া গেছে এ বছর। এমন কাজ করেছে একাধিক বেসরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। এ ঘটনার পেছনে ব্যাংক ও গ্রাহকের জোগসাজশ থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

Share