অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও রিজার্ভ বাড়াতে আইএমএফের ৩ পরামর্শ

ডলারের দাম আরও ২৫ পয়সা কমানোর সিদ্ধান্ত

গাজী আবু বকর : অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও রিজার্ভ বাড়াতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ সরকারকে ৩টি পরামর্শ দিয়েছে। আইএমএফ বলছে, সরকার চলমান সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারলে আগামী দিনে রিজার্ভ বাড়তে শুরু করবে। ফলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এবং চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ রিজার্ভ চার মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান হতে পারে। আইএমএফের সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে-মুদ্রানীতিকে আরও কঠোর ও সংস্কার করা, ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারকে আরও নমনীয় করা এবং নিরপেক্ষ রাজস্ব নীতি অনুসরণ করা। গত ১২ ডিসেম্বর আইএমএফ-এর ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ বাবদ ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার ছাড় করার প্রস্তাব অনুমোদনের পর সংস্থাটির নির্বাহী পর্ষদ এসব সুপারিশ করেছে। প্রথম কিস্তিতে গত ২ ফেব্রুয়ারি ৪৪৭ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার ছাড় দেয় সংস্থাটি। বর্তমানে দেশে বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে হিসাবকৃত তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ নিট রিজার্ভ রয়েছে ১৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।

আইএমএফের ঋণের পাশাপাশি আগামী সপ্তাহে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে বাংলাদেশ ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ পাবে। চলতি ডিসেম্বরের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আরও ৯০ মিলিয়ন ডলার এবং অন্যান্য উৎস থেকে ১৩০ মিলিয়ন ডলার আসবে। আইএমএফ মনে করছে, আগামীতে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার এখনকার তুলনায় কমবে। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে। আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদের সভায় ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের পর বাংলাদেশ ব্যাংক এমন মূল্যায়ন তুলে ধরেছে। উল্লেখ্য, আইএমএফ-এর তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রাক্কলন করেছে আইএমএফ। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি আছে ৯ শতাংশের ওপরে।

গতকাল বৃহষ্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে হিসাবকৃত তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ নিট রিজার্ভ ১৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ৯১৬ কোটি ৯০ লাখ ২ হাজার ডলার। দেশে বর্তমানে স্থানীয় বিনিয়োগসহ মোট গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ২৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৪৬২ কোটি ৭৩ লাখ ৬০ হাজার ডলার। যা এক বছর আগে ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর তারিখে গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ছিলো ৩৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার বা ৩ হাজার ৩৮৪ কোটি ৯৩ লাখ ৩০ হাজার ডলার।

রিজার্ভের এই নাজুক অবস্থার মধ্যে আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা বাবদ ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ আবার ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসতে পারে। এদিকে আইএমএফ যে পূর্বাভাস দিয়েছে তাতে চলতি অর্থবছরের শেষে গ্রস রিজার্ভ আরও কমবে। জুনের শেষে রিজার্ভ দাড়াবে ২ হাজার ৪৩০ কোটি ডলারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত পৌনে দুই বছর ধরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে নানা ধরনের সংকট চলছে। রিজার্ভ কমতে থাকায় ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। কমেছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। এতে বিশেষ করে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে গেছে। রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সরকার আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নিচ্ছে কঠিন শর্ত মেনে। তারপরও রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। ২০২১ সালের আগস্টে গ্রস রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলারে উঠেছিল। এরপর থেকে রিজার্ভ কমছে। গত বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে গ্রস রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৬৩ কোটি ডলারে। গত দুই বছর চার মাসে গ্রস রিজার্ভ কমেছে ২ হাজার ৩৪৩ কোটি ডলার। প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে।

এদিকে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি বাবদ ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার আজ শুক্রবার ছাড় হতে পারে। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে জমা হলে গ্রস রিজার্ভ বেড়ে ২৫ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করবে। তখন রিজার্ভ ২ হাজার ৫৩২ কোটি ডলারে দাঁড়াবে। একই সঙ্গে নিট রিজার্ভ হবে ১ হাজার ৯৮৬ কোটি ডলার। চলতি মাসের মধ্যে আরও কয়েকটি সংস্থা থেকে বৈদেশিক ঋণের অর্থ ছাড় হবে। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ৪০ কোটি ডলার, দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের একটি তহবিল ৯ কোটি ডলার ও অন্যান্য সংস্থা মিলবে আরও ১৩ কোটি ডলার। আইএমএফসহ মিলবে মোট ১৩১ কোটি ডলার। এসব ঋণের কারণে নিট রিজার্ভ বেড়ে ডিসেম্বরের শেষে দাঁড়াবে ২ হাজার ৪৮ কোটি ডলার ও গ্রস রিজার্ভ হবে ২ হাজার ৫৯৪ কোটি ডলার। ডিসেম্বরের মধ্যে ছোট ছোট কিছু দেনা পরিশোধ করতে হবে। এর বাইরে বড় কোনো দেনা নেই। ফলে ডিসেম্বরের রিজার্ভ থেকে অর্থ খরচ কম হবে। অন্যদিকে ঋণের অর্থ পাওয়া গেলে রিজার্ভ বাড়বে।
তবে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আকুর দেনা বাবদ ১০০ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধ করতে হবে। তখন নিট রিজার্ভ আবার ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসবে। একই সঙ্গে গ্রস রিজার্ভও কমে ২৪ বিলিয়নে নামতে পারে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বড় অংকের বৈদেশিক ঋণ পাওয়া যাবে না। ফলে ওই সময়ে রিজার্ভ আবার কমে যেতে পারে। কারণ ফেব্রুয়ারিতে আবার আকুর দেনা পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ আরও কমতে পারে। আইএমএফ রিজার্ভের যে পূর্বাভাস দিয়েছে তাতে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত রিজার্ভ কমবে। আগামী জুনে গ্রস রিজার্ভ কমে ২ হাজার ৪৩০ কোটি ডলারে দাঁড়াতে পারে, যা এখনকার চেয়ে ৩৩ কোটি ডলার কম। অর্থাৎ ঋণ পেলেও মধ্যমেয়াদে রিজার্ভ বাড়ছে না। বরং কমছে।

এদিকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধের চাপ এখনও রয়েছে। স্বল্পমেয়াদি ঋণ এখন ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রায় ৮০০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে আগামী জুনের মধ্যে। এছাড়া আগামী বছরে সবচেয়ে বেশি দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সব মিলে ২০২৪ সালে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে। এর সঙ্গে আমদানি ব্যয়ও বাড়তে পারে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে চালসহ অনেক পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে।

আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে আমদানি ব্যয় বাড়বে কম, সে তুলনায় রপ্তানি আয় বাড়বে বেশি। তবে আগামী বছরে রপ্তানি আয় বাড়বে কম, আমদানি ব্যয় বাড়বে বেশি। ফলে চলতি হিসাবে ঘাটতিও বেড়ে যাবে। চলতি হিসাবের ঘাটতি বিবেচনায় নিয়ে আগামী বছরেও ডলারের সংকট কাটবে না। বৈদেশিক মুদ্রার সার্বিক হিসাবেও ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি না কমলে রিজার্ভ বাড়বে না। ফলে মধ্যমেয়াদে রিজার্ভ বাড়ার সম্ভাবনা নেই। তবে আইএমএফের হিসাবে ২০২৫ সালে গ্রস রিজার্ভ বেড়ে ৩ হাজার কোটি ডলারের ঘর অতিক্রম করবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, শীতে প্রবাসীরা দেশে আসে। এ কারণে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে রেমিট্যান্স বাড়তে পারে। এছাড়া মার্চে রোজার ঈদ ও মে মাসে কুরবানির ঈদ। এই দুই সময়েও রেমিট্যান্স বাড়তে পারে। ইউরোপের মন্দাও কাটতে শুরু করেছে। ফলে রপ্তানি আয় বাড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আইএমএফ যে মূহুর্তে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার নমনীয় করার কথা বলছে, সেই মূহুর্তে সরকার ডলারের বিনিময় হারে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। সংকটের মধ্যে ডলারের দাম আরও ২৫ পয়সা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংকগুলো। ফলে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কেনায় ডলারের দাম পড়বে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা আর আমদানিতে পড়বে ১১০ টাকা। তবে নির্ধারিত দামে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে কম। গতকালও ব্যাংকগুলো ১২৩ টাকার বেশি দামে প্রবাসী আয় কিনেছে।
বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) গত বুধবার রাত ১০টায় অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল সভায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আগামী রোববার থেকে কার্যকর হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংগঠন দুটি। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কিনতে ডলারের দাম হবে সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা; আগে যা ছিল ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা। আর আমদানি দায় মেটাতে ডলারের দাম নেওয়া যাবে ১১০ টাকা, আগে যা ছিল ১১০ টাকা ২৫ পয়সা। প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে সরকারের ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যাংকও সমপরিমাণ প্রণোদনা দিতে পারবে। ফলে প্রবাসী আয় পাঠালে ডলারপ্রতি সর্বোচ্চ ১১৪ টাকা ৫০ পয়সা পাবেন উপকারভোগীরা।
উল্লেখ্য, ডলারের জোগান ও চাহিদার ওপর নির্ভর করে সময় সময় বাফেদা ও এবিবি ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করে আসছে। এ দুটি সংগঠন মূলত বাণিজ্যিক ব্যাংক–সংশ্লিষ্ট। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে তারা সময় সময় ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তুসব ব্যাংক সংগঠন দুটির নির্ধারিত দামে ডলার কেনাবেচা করছে না। এখন যেসব ব্যাংক বেশি দাম দিচ্ছে, তারাই প্রবাসী আয়ের ডলার বেশি কিনতে পারছে। প্রবাসী আয় সংগ্রহে গতকালও ১২৩ টাকা দাম দিয়েছে রেমিট্যান্স হাউসগুলো। এর চেয়ে বেশি দামে তাদের থেকে প্রবাসী আয় কিনেছে দেশের ব্যাংকগুলো। ফলে আমদানিকারকদের এর চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সামনে নির্বাচনের জন্য বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা না করে কৃত্রিমভাবে ডলার–সংকট কাটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে চলতি মাসে তিন দফায় ডলারের দাম ১ টাকা কমানো হয়েছে। রিজার্ভ বাড়াতে ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কেনা হচ্ছে। অথচ ব্যাংকগুলো আমদানি দায় শোধ করতে পারছে না। তাই বিভিন্ন দেশের ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বাফেদা ও এবিবি নেতারা বলছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ অনুমোদন হয়েছে। এ ছাড়া এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) বাজেট সহায়তার অর্থ আসবে। সব মিলিয়ে চলতি মাসে বিদেশি ঋণ আসবে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ফলে রিজার্ভ বাড়বে, এই যুক্তি তুলে ধরে তাঁরা ডলারের দাম কমানোর ঘোষণা দেন। এ প্রেক্ষাপটে খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহে বিরুপ প্রভাব পড়বে। আগামী দিন গুলোতে হুন্ডি বাড়বে। কমবে প্রবাসী আয়।

রপ্তানিমুখী শিল্পে বৈদেশিক এলসির বকেয়া দায় ৯৪০০ কোটি টাকা

আগে রপ্তানি খাতের কাঁচামাল আমদানির জন্য বৈদেশিক ‘ব্যাক টু ব্যাক’ এলসি’র কোনো দায় বকেয়া থাকত না। করোনার সময় থেকে এ খাতে সময় মতো দায় পরিশোধ করতে না পারায় বকেয়া থাকছে। গত জুন পর্যন্ত এ খাতে বকেয়া স্থিতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৫ কোটি ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯ হজার ৪০০ কোটি টাকা। তবে গত বছরের জুনের তুলনায় এ খাতে দায়ের স্থিতি কমেছে ৩২ কোটি ডলার। যা স্থানীয় মুদ্রায় তিন হাজার ৫৫০ কোটি টাকা।

এক বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক ‘ব্যাক টু ব্যাক এলসি’র দায় কমেছে ২৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। রপ্তানি খাতের সার্বিক চিত্র নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি একটি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হয় ‘ব্যাক টু ব্যাক’ এলসির বিপরীতে কাঁচামালের মূল্যের পুরোটাই রপ্তানিকারকদের নামে ঋণ হিসাবে ইস্যু করে পরিশোধ করে ব্যাংক। রপ্তানির মূল্য দেশে আসার পর ব্যাংক ঋণ বাবদ দেওয়া অর্থ সমন্বয় করে বাকি অর্থ রপ্তানিকারকের হিসাবে স্থানান্তর করে। এ কারণে এ ধরনের ঋণকে নিরাপদ মনে করে ব্যাংক অর্থায়ন করে।

আগে এসব খাতের এলসির কোনো দায়দেনা বকেয়া থাকত না। করোনার সময় বৈশ্বিক লকডাউনের কারণে নিয়মিত রপ্তানি আয় দেশে বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে ব্যাংক রপ্তানি আয় থেকে ঋণ সমন্বয় করতে পারছিল না। এ কারণে এ খাতে বকেয়া বাড়তে থাকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, করোনার কারণে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বৈদেশিক ‘ব্যাক টু ব্যাক এলসি’র দায় বকেয়া হয়েছিল ৯৪ কোটি ১৩ লাখ ডলারের। যা মোট স্বল্পমেয়াদি ঋণের ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ওই সময়ে বেসরকারি খাতে মোট স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল এক হাজার ১৮৩ কোটি ডলার। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা বাণিজ্যে করোনার নেতিবাচক প্রভাব শেষ না হতেই ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এর প্রভাবে আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যায়। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স কমার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহও কমে যায়। এতে ডলারের সংকট প্রকট হয়। লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে ডলারের দাম। ডলারের সংকট প্রকট হলে বৈদেশিক ব্যাক টু ব্যাক এলসির বকেয়া দায় বাড়তে থাকে।

২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ১১৬ কোটি ৬৮ লাখ ডলারে। যা মোট স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। ওই সময়ে বেসরকারি খাতে মোট স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ ছিল এক হাজার ৭৭৬ কোটি ডলার।

২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে বৈদেশিক ব্যাক টু ব্যাক এলসির বকেয়া দায় বেড়েছিল ২৩ কোটি ডলার। বৃদ্ধির হার ছিল ২৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ডলার সংকট মোকাবিলায় আমদানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের ফলে আমদানি কমতে থাকে। বৈশ্বিক মন্দায় পণ্য রপ্তানিও কমতে থাকে। এর প্রভাবে রপ্তানির অর্ডার আসা যেমন কমে, তেমনি কাঁচামাল আমদানিও কমে যায়। ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতের বৈদেশিক এলসির বকেয়া দায়ও কমতে থাকে। গত বছরের জুনে তা কমে দাঁড়ায় ৮৪ কোটি ৬৫ লাখ ডলারে। যা বেসরকারি খাতে মোট স্বল্পমেয়াদি ঋণের ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। আগের অর্থবছরের চেয়ে কমেছে ৩২ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় তিন হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। কমার হার ২৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ওই বছরে মোট স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল এক হাজার ৩৬৬ কোটি ডলার।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা হয়েছিল ৮৩৮ কোটি ডলার। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৯৫৩ কোটি ডলার। গত ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় এলসি খোলা ৩১ শতাংশ এবং আমদানি ১৯ শতাংশ কমেছিল। গত অর্থবছরের জুলাই অক্টোবরে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা হয়েছিল ৩১৫ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে খোলা হয় ৩০৮ কোটি ডলার। ওই সময়ে এলসি খোলা কমেছে ২ দশমিক ০৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে ওই সময়ে ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় আমদানি হয়েছিল ৩৭৩ কোটি ডলার।

চলতি অর্থবছরের আমদানি হয়েছে ২৭৫ কোটি ডলার। যা ২৬ দশমিক ১৮ শতাংশ কম। গত নভেম্বরে মোট ৮০ কোটি ডলার ও চলতি ডিসেম্বরে ৭৫ কোটি ডলারের ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা হতে পারে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে। অর্থাৎ ব্যাক টু ব্যাক এলসি কমছে। এটি কমার কারণে আগামীতে রপ্তানি আয়ও কমতে পারে। গত জুন পর্যন্ত অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয়ের পরিমাণ প্রায় ১৩৫ কোটি ডলার। বৈশ্বিক মন্দায় বিদেশি ক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনেকে পণ্যমূল্য পরিশোধ করতে পারছে না। এ কারণে রপ্তানি আয় দেশে আসছে কম।

ডলার সংকট মোকাবিলা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাশ্রয়ে গত পৌনে দুই বছর ধরে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ব্যাপকভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, বৈশ্বিক মন্দা ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামালের আমদানিও কমেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে রপ্তানি খাতে পড়তে শুরু করেছে। এর মধ্যে নতুন আতঙ্ক হিসাবে দেখা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমনীতিতে শ্রমিক অধিকারের বিষয়টি।

Share