এসআইকে থাপ্পড় মেরে প্রদীপ বলেন, টেকনাফে ভালো মানুষ আসে?

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : কথামতো দুই তরুণের বিরুদ্ধে ইয়াবার মামলা না দেওয়ায় তার থানার এক উপপরিদর্শককে (এসআই) থাপ্পড় মেরেছিলেন টেকনাফের সদ্য সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে লকডাউন চলাকালে জুন মাসে নারায়ণগঞ্জের দুই ভাই রায়হান মিয়া প্রীতম (২৮) ও মো. লিংকন (১৮) কক্সবাজার গিয়েছিলেন। তবে সেখানে হোটেল-মোটেল বন্ধ থাকায় বিপদে পড়েন দুই ভাই। পরে এক অটোরিকশাচালক তাদের জানান, টেকনাফে গেলে দু’জনের থাকার ব্যবস্থা করতে পারবেন তিনি। অটোরিকশাচালকের কথায় আস্থা রেখে টেকনাফ চলে যান প্রীতম ও লিংকন। সেখানে ওই অটোরিকশা চালক ও তার সঙ্গীরা দুই তরুণকে আটক করে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করেন।

অপহরণকারীদের আস্তানা থেকেই এক নারীর মোবাইল ফোন থেকে জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এ ফোন করেন প্রীতম। ওই ফোনকলের আগেই কৌশলে অপহরণকারীদের আস্তানা থেকে পালিয়ে যান লিংকন। ৯৯৯ থেকে কল পেয়ে পরে টেকনাফ থানার একজন এসআই প্রীতমকে অপহরণকারীদের ডেরা থেকে উদ্ধার করেন। এরপর তাকে নেওয়া হয় টেকনাফ থানায়। ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে পুরো ঘটনা খুলে বলেন ওই এসআই। এরপর দুই তরুণের স্বজনের সামনেই এসআইকে থাপ্পড় মেরে প্রদীপ বলেন, ‘ওরা ইয়াবা কারবারের সঙ্গে জড়িত। ইয়াবা দিয়ে চালান দেওয়া হবে। কোন সাহসে ৯৯৯-এ ফোন করল সে। টেকনাফ খারাপ জায়গা। এখানে কোনো ভালো মানুষ আসে!’ প্রদীপের রোষানলে পড়ে প্রীতম ও লিংকনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হওয়ার এমন করুণ কাহিনি শনিবার সমকালের কাছে তুলে ধরেন প্রীতমের বাবা হুমায়ুন কবির।

প্রীতম মালয়েশিয়া থেকে করোনা সংক্রমণের আগে দেশে ফেরেন। আর লিংকন স্থানীয় পাঁচরুখী বেগম আনোয়ারা কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। দু’জনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের সাতগাঁ ইউনিয়নে। চলতি বছরের জুনে এলাকায় মারামারিতে জড়ান তারা। পরে এ নিয়ে সালিশ হয়। সেখানে ঠিক হয়, তাদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। শাস্তির ভয়ে লকডাউনের মধ্যে কৌশলে কক্সবাজার চলে যান তারা।

প্রীতমের বাবা হুমায়ুন কবির আরও বলেন, বাড়ি থেকে উধাও হওয়ার পর লকডাউনের মধ্যে তাদের খোঁজ না পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। দু’দিন পর আড়াইহাজার থানায় জিডি করি। এরপর ফোন করে ছেলের মুক্তিপণ বাবদ এক লাখ ২০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে ছেলেকে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি আড়াইহাজার থানার ওসিকে জানাই। ওসি ওই নম্বর ট্র্যাক করে জানান, মোবাইলটি টেকনাফ থানা এলাকায় ব্যবহৃত হচ্ছে। লকডাউনের মধ্যে ওসির পরামর্শে স্থানীয় জুয়েল, রফিকুল হামিদ জেনারেলকে নিয়ে টেকনাফের উদ্দেশে রওনা হন তারা। কেউ যাতে পথে না আটকায় এ জন্য একটি স্লিপও দিয়ে দেন ওসি। সেটা নিয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত পৌঁছার পর তারা জানতে পারেন, কৌশলে টেকনাফের অপহরণকারীদের আস্তানা থেকে বের হয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন লিংকন। এরপর তিনি কক্সবাজারে তার এক আত্মীয়র বাসায় ওঠেন। লিংকনের ছাড়া পাওয়ার বিষয়টি আড়াইহাজার থানা পুলিশকে অবগত করেন তারা। পুলিশের পরামর্শে লিংকনকে নিয়ে টেকনাফের দিকে তারা রওনা হন। যাতে অপহরণসহ সার্বিক ঘটনা টেকনাফ থানা পুলিশকে জানাতে পারেন লিংকন। টেকনাফ থানায় যাওয়ার পর তারা জানতে পারেন, ৯৯৯-এ প্রীতমের ফোনকলের মাধ্যমে টেকনাফ থানার এক এসআই তাকে মুক্ত করে থানায় নিয়ে আসছেন। কিছুক্ষণ পর লুঙ্গি পরা অবস্থায় প্রীতমকে থানায় নিয়ে আসেন ওই এসআই। এরপর ওসির কক্ষে ঘটনার বিস্তারিত জানান ওই এসআই। এটা শোনার পর ওসি প্রদীপ বলেন, ‘বাপসহ ওরা ইয়াবা কারবারি। লকডাউনের মধ্যে কেন ওরা টেকনাফ আসবে। সব কটারে ইয়াবাসহ চালান দে।’ এটা শোনার পর ওই এসআই বলেন, ‘স্যার ৯৯৯-এ ফোনকলের পর ওকে উদ্ধার করেছি। ইয়াবার সঙ্গে জড়িত নয়।’ এরপরই এসআইকে থাপ্পড় মারেন ওসি প্রদীপ।

আড়াইহাজারের সাতগাঁ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল হামিদ জেনারেল বলেন, প্রীতম ও লিংকন দু’জন আমাদের দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। ঘটনাটি জানার পর প্রীতমের বাবার সঙ্গে কক্সবাজারে যাই। ওসিকে কোনোভাবে বোঝানো যাচ্ছিল না ওদের একজন ছাত্র। আরেকজন বিদেশফেরত। ঘটনাচক্রে টেকনাফ এসে বিপদে পড়েছে। ওসি আমাদের অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করছিলেন। এরপর প্রীতমের প্যান্টের পকেটে ৪০০ পিস ইয়াবা পাওয়া গেছে- এটা দেখিয়ে তাকে মাদক মামলায় চালান দেওয়া হয়। আর লিংকনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ১৫ দিনের সাজা দেওয়া হয়। পুরো ঘটনা নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের এমপিকে জানিয়ে ওসি প্রদীপকে ফোন করতে অনুরোধ করি। এমপির অনুরোধও পাত্তা দেননি প্রদীপ। এ ছাড়া আড়াইহাজার থানা থেকে ওসি প্রদীপকে বলা হয়, ওই দুই তরুণ মাদকের সঙ্গে যুক্ত নয়। এটাও আমলে নেননি তিনি। উল্টো ওসি বলেন, টেকনাফে বেশি সময় থাকলে প্রীতম ও তার স্বজনদেরও মাদকসহ চালান দেওয়া হবে।

রফিকুল হামিদ জেনারেল আরও জানান, থানার পাশের এক দোকানিও আমাদের পরামর্শ দেন- ‘দ্রুত টেকনাফ ছাড়ূন। নইলে বিপদ আছে। কারণ ওসি প্রদীপের কথার চেয়ে বেশি গুলি চলে। এটা শোনার পর ভয়ে আমরা দ্রুত টেকনাফ থেকে চলে আসি।’

প্রীতমের চাচা জুয়েল জানান, মিথ্যা মামলায় এখনও কক্সবাজারের জেলে রয়েছেন প্রীতম। আর লিংকন মুক্তি পেয়েছেন। ওসি প্রদীপ যে আচরণ করেছেন, এটা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়।

কলেজছাত্র লিংকন বলেন, দু’দিন থানায় আটকে রাখা হয়েছিল। ওসি প্রদীপের পায়ে ধরেছি যাতে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো না হয়। এরপরও ১৫ দিনের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তবে আমার ভাইকে ছাড়েনি। যে চক্র আমাদের অপহরণ করেছিল তাদের মধ্যে জায়েদ উদ্দিন নামে একজনকে আটক করা হয়েছিল। আমাদের সঙ্গে প্রদীপ বিশ্রী ব্যবহার করলেও জায়েদকে কিছু বলেননি।

প্রীতম ও অপহরণকারী চক্রের সদস্য জায়েদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার এজাহারে দাবি করা হয়- টেকনাফ থানাধীন হোয়াইকংয়ের লম্বাঘোনা এলাকায় হাবিব উল্লাহর বাড়ির সামনে একটি চক্র ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি করছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালিয়ে প্রীতম ও জায়েদকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের সহযোগী অপর একজন হাতে থাকা বাজারের ব্যাগসহ দৌড়ে পালিয়ে যায়।

Share