কর ফাঁকি ও অস্বচ্ছতায় বছরে ২ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা হারাচ্ছে সরকার : সিপিডি

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : কর ফাঁকি ও অস্বচ্ছ ব্যবস্থার কারণে সরকার বছরে ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কেটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। টাকার এই অংক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ অর্থের ৮ গুণ; আর স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের দুইগুণ। এ ছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে সরকার বছরে রাজস্ব হারাচ্ছে প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকা।গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে সংস্থাটির কার্যালয়ে ‘কর্পোরেট খাতে কর স্বচ্ছতা ; জাতীয় বাজেটে এর প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এ সময় উপস্থিত ছিলেন। সিপিডি ও খ্রিস্টিয়ান এইডের সহযোগিতায় গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়।

কর ফাঁকির ধরন তুলে ধরে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, কর অস্বচ্ছতাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়, কর ফাঁকি ও কর এড়ানো। কর ফাঁকি দিতে গিয়ে কোম্পানি তার প্রকৃত আয় কম দেখায়। অন্যদিকে আইনি কাঠামোর আওতায় সরকারের দেওয়া সুবিধা গ্রহণ করে কর কম দিয়ে থাকে। এটাও কর অস্বচ্ছতা।

গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, ১৫ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কর ফাঁকির তথ্য পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে প্রতিবছর সর্বনিম্ন ৪১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এ ছাড়া সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত করছাড় দেওয়া হয়। এভাবে প্রতিবছর ১৪ হাজার কোটি টাকা থেকে ৬৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব পাচ্ছে না সরকার। দুই খাত মিলে ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬৮ শতাংশ মানুষ করযোগ্য আয় করার পরও আয়কর দেন না। কর জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি না হওয়ার কারণে এটা হচ্ছে। অন্যদিকে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে ২ লাখ ১৩ হাজার কোম্পানি রেজিস্টার্ড হলেও রিটার্ন দাখিল করে মাত্র ৪৫ হাজার কোম্পানি।

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে ২০১০ সালে করের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, এই খাত থেকে সরকার প্রতিবছর ৮৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে, যা জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ। এই টাকা যদি পাওয়া যেত তাহলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় তিনগুণ করা যেত। অর্থাৎ, কর নেট বৃদ্ধির প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। বড় অংশই করের বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে কর ক্ষতি দিন দিন বাড়ছে।

এমন পরিস্থিতিতে কর-জিডিপির অনুপাত ৯ শতাংশে নেমে আসার তথ্য উল্লেখ করে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আইএমএফ এবং বিশ্ব ব্যাংকের মানদণ্ড অনুযায়ী একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশে অবশ্যই কর জিডিপির হার ১২ থেকে ১৫ শতাংশ হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশের কর আদায় পরিস্থিতি সেই মান থেকে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে।

কর্পোরেট কর হার বেশি হওয়ায় কর ফাঁকির প্রবণতা বাড়ছে বলে সিপিডির গবেষণায় উঠে এসেছে। বাংলাদেশে কর্পোরেট করহার এখনও এশিয়া এমনকি আফগানিস্তানের পর দক্ষিণ এশিয়াও সর্বোচ্চ বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। কর ফাঁকি ও কর এড়ানোর বৈশ্বিক চিত্র তুলে ধরে মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, এক্ষেত্রে ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫২তম।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, একটি যৌক্তিক, স্বচ্ছ ও প্রগতিশীল সুসম কর ব্যবস্থা জাতীয় উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কর ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার আয় করে থাকে। সেই আয়ই জাতীয় বিভিন্ন উন্নয়নে ও সামাজিক উন্নয়নে খরচ হয়ে থাকে। এই কর ব্যবস্থা যতটা আধুনিক হবে কর আহরণ ও তত স্বচ্ছতার সঙ্গে হবে, উন্নয়নের জন্য আমরা তত ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারবো।

তিনি বলেন, আমরা বলে থাকি উন্নয়নে আমাদের বাস্তব জায়গা দরকার। সেই অবস্থা তৈরির জন্য প্রধান উপায় হলো অভ্যন্তরীণ সম্পদ সঞ্চালন। অভ্যন্তরীণ সম্পদের সঞ্চালনের প্রধান দিক হলো কর্পোরেট ট্যাক্স। এ জন্য কর্পোরেট করের স্বচ্ছতা নিয়ে আলোচনা জরুরি।

গবেষণায় বেশকিছু সুপারিশ করা হয়। এগুলো হচ্ছে– কর ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে সমন্বিত পদ্ধতিতে আর্থিক লেনদেন চালু করতে হবে। বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে সুনির্দিষ্ট খাত থেকে কর আদায় করতে হবে। কর প্রশাসনকে আরও শক্তিশালী ও আধুনিকায়ন করতে হবে। যারা কর ফাঁকি দেন তাদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। প্রত্যেক কোম্পানির আলাদা আলাদা আইডি নম্বর থাকবে, যার মধ্যমে খুব সহজেই কর প্রদানের তথ্য নিশ্চিত হওয়া যাবে।

এ ছাড়া করছাড় ক্রমন্বয়ে কমিয়ে আনতে হবে। যেসব খাতে ছাড় দেওয়া হচ্ছে, তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে কি-না সেটি নির্ণয় করতে হবে। কর খাতের নায্যতা প্রতিষ্ঠায় বাজেটে কালো টাকা সাদা করার বিধান বন্ধ করতে হবে।

Share