বিপ্লব ও ফরমান: সরকার ও সংবিধান

কাজী হাবিবুল আউয়াল : নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক সংকটে। আলোচনার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কমিশনের প্রধান হিসেবে পত্রিকায় লিখে জনগণকে অবহিত করাই সমীচীন মনে করছি। ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনের পতন হয়েছে। বিপ্লবটি ছিল তারুণ্যের শক্তিতে উদ্দীপ্ত ব্যাপক জনসম্পৃক্ত অনন্য সাধারণ এক অসাধ্য সাধন। অসংখ্য নিরীহ শিশু-কিশোর, তরুণ ও বৃদ্ধকে জীবন দিতে হয়েছে। তবে বিশেষ একটি কারণে বিপ্লবোত্তর এই সময়ে খানিকটা সাংবিধানিক শূন্যতা দৃশ্যমান। সংবিধান কতটুকু বা কীভাবে বলবৎ আছে বোধগম্য হচ্ছে না। স্পষ্টতা প্রয়োজন। অস্পষ্টতা অনাকাঙ্ক্ষিত। ভবিষ্যতে আইনগত জটিলতা হতে পারে। সুদূর অতীতে সমস্যা ছিল না। তখন আইনকে বলা হতো রাজার হুকুম। আধুনিক বিশ্বে আইন রাজার হুকুম নয়। আইন কাগজে লিখে গেজেট করতে হয়। আইনের সিদ্ধতা ও শাসন উপেক্ষণীয় নয়। বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরশাসনের অবসান বা স্বৈরশাসকের অপসারণই চূড়ান্ত লক্ষ্য বা অর্জন নয়। আরাধ্য অনেক কর্ম সম্মুখে অপেক্ষমাণ। সেগুলো সমাধা করতে হবে। কঠিন প্রতিজ্ঞা, বিচক্ষণতা, সাহস ও সততায় অবিচল না থাকলে কর্মটি খুব সহজ হবে না।

সামরিক অভ্যুত্থান হলে সামরিক ফরমান দ্বারা সংবিধানকে অবিলম্বে রহিত বা স্থগিত করা হয়। স্থগিত করা হলে ফরমানকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে অগ্রগণ্যতা দেওয়া হয়। অর্থাৎ ফরমান ও স্থগিত সংবিধানের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে ফরমানকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আইনের শাসনের ধারাবাহিকতাকে এভাবে বজায় রাখা হয়। বিপ্লবী সরকার শপথ নিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে আগাম বৈধতা নেওয়া হয়েছে। পরে আপিল বিভাগকেই বিদায় করা হয়েছে। আমার সোজাসাপ্টা কথা হচ্ছে, গণঅভ্যুত্থান কার্যকর করতে আদালতের অনুমোদন প্রয়োজন হয় না। গণঅভ্যুত্থান একটি স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতা (সেল্ফ এভিডেন্ট)। আইনের ঊর্ধ্বে এর অবস্থান। তবে বিপ্লবোত্তর সময়ে আইনের ঊর্ধ্বে একটি ফরমান অনিবার্যভাবে প্রয়োজন। সামরিক আমলারা তা জানেন। সুশীল আমলারা সেটা বোধকরি জানেন না।

গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পতন হলে, ইতোপূর্বে বহাল থাকা সরকারকে অপসারণ করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হলে, সংবিধান অকার্যকর হয়ে যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অবিলম্বে একটি অসামরিক ফরমান জারি করে প্রচলিত সংবিধানকে বাতিল বা স্থগিত বা পাশাপাশি বহাল রেখে, অসামরিক ফরমানকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে অবস্থান দেওয়া হলে সাংবিধানিক বা আইনগত সংকট পরিহার করা যেতে পারে। এটি বহুল অনুসৃত পদ্ধতি।

ইতিহাসে সফল গণঅভ্যুত্থানের অনেক নজির রয়েছে। ১২১৫ সালে বিলেতের ম্যাগনাকার্টা, ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব এবং ১৯১৭ সালের রুশ তথা বলশেভিক বিপ্লব ইতিহাসের পাঠ্য হয়ে ভবিষ্যতের অনেক বিপ্লবকে প্রেরণা জুগিয়ে উৎসাহিত করেছে।

প্রায় প্রতিটি সফল বিপ্লবকে প্রতিবিপ্লবের ধকল সামলাতে হয়েছিল। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী সময়টা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। একের পর এক প্রতিবিপ্লব কঠোর হাতে দমন করে ১৭৯৩ সালে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছিল। ১৭৯৯ সালে সেনাপতি নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তগত করে পরে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেছিলেন।

১৯১৭ সালের রুশ বলশেভিক বিপ্লবকে অনেক কয়টি প্রতিবিপ্লব দমন করে ১৯২৩ সালে চূড়ান্ত বিজয় বা সফলতা অর্জন করতে হয়েছিল।

দাস প্রথাকে নিয়ে ১৮৬১-৬৫ সালে সংঘটিত আমেরিকার গৃহযুদ্ধ ছিল বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবের সংমিশ্রিত এক জটিল আখ্যান। দাস প্রথা বহাল রাখা ও বিলোপ সাধনের জন্য আমেরিকার উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মধ্যে সেটি ছিল এক মরণপণ দ্বৈরথ।

সাম্প্রতিক সময়ে রোমানিয়া, ইরান, ইরাক, মিসর, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়াসহ অনেক দেশে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান আধুনিক ডিজিটাল গণমাধ্যমের সুবাদে আমাদের চোখের সামনেই সংঘটিত হয়েছে। আরব বসন্তে মিসরের সফল বিপ্লব অচিরেই কুটিল চক্রান্তে ব্যর্থ হয়ে গেল। মুরসির করুণ মৃত্যু আমাদের চোখের সামনেই ঘটল। বিপ্লবোত্তর সময়ে আইন-কানুন ভেঙে পড়ে। আরব বসন্ত তিউনিসিয়াতে সফল হলেও বাকি দেশগুলোতে বরং উত্তরকালে ব্যর্থই হয়েছিল। আইন-কানুন ও জনশৃঙ্খলা পুনর্বহাল বিপ্লবী সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। আইনের শাসন পুনর্বহাল করে সমুন্নত রাখতে সাময়িক বিপ্লবী আইন তথা সামরিক বা অসামরিক ঘোষণাপত্র আইন বা আদেশ (প্রক্লেমেশন অর্ডার) প্রণয়ন করে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। আইন বিজ্ঞানে ডি জুরে (আইনানুগ) এবং ডি ফ্যাক্টো (বাস্তবানুগ) সংঘাত নিরসনের এমন অনুসৃত পদ্ধতি নতুন নয়। অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। অনুসরণ করাই বাঞ্ছনীয়। এসব বিষয়ে মাকর্স, এঙ্গেলস, হেগেল, রুশো, কান্টসহ অনেক দার্শনিক ও আইনবিজ্ঞানীর বিস্তর লেখালেখি রয়েছে। তারা শক্তি তত্ত্ব (ফোর্স থিওরি) বা উপযোগিতা তত্ত্ব (ইউটিলিটারিযান থিওরি) দিয়ে গণবিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের যথার্থতা প্রতিপাদন করেছেন।

নির্বাচন কমিশন সংবিধান ও সফল বিপ্লবোত্তর সাংবিধানিক পরিস্থিতিতে সংকটে রয়েছে। নির্বাচন কমিশন হয়তো অচিরেই বিগত হবে। কিন্তু এতে সংকটের নিরসন হবে না। সংসদ অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে ভেঙে দিতে হয়েছে। সফল বিপ্লবের ডি ফ্যাক্টো (বাস্তবানুগ) গ্রামারে এটি অবশ্যই সিদ্ধ। সংবিধান যদি বহাল থাকে তাহলে নির্বাচন কমিশনকে সংবিধানের ১২৩(৩)(খ) অনুচ্ছেদের বিধানমতে তৎপরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। যদি না করেন, তাহলে সে ক্ষেত্রে ৭খ অনুচ্ছেদের বিধানমতে কমিশনাররা মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ করে থাকবেন। সংবিধানকে পুরোপুরি অক্ষুণ্ন রেখে বিপ্লব তথা বিপ্লবের উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নেওয়া ও বাস্তবায়ন করা যায় না।

৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অসম্ভব। এটাকে বলা হয় উভয় সংকট। ঘাড়ের ওপর ডেমোক্লিসের তরবারি। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণ যখনই হোক না কেন, রাষ্ট্র ও সরকারের আইনগত ও সাংবিধানিক ভিত্তি মজবুত করতে হলে সফল বিপ্লবোত্তর উদ্ভূত এমন পরিস্থিতিতে অবিলম্বে একটি অসামরিক ফরমান জারি করে প্রচলিত সংবিধান স্থগিত বা পাশাপাশি বহাল রেখে অসামরিক ফরমানকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে অবস্থান প্রদান করে সাংবিধানিক বা আইনগত সংকট পরিহার করা প্রয়োজন। অধিকন্তু বলা হচ্ছে এবং শোনা যাচ্ছে, নির্বাচন, বিচার এবং প্রশাসনে ব্যাপক সংস্কার করা হবে। সংবিধানে পরিবর্তন ব্যতিরেকে অনেক কাঙ্ক্ষিত সংস্কার হয়তো আইনত সম্ভব হবে না। যথাযথ ফরমান থাকলে তার অধীনে সংবিধানে সংস্কার আনা সম্ভব। অতীতে করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান করেছেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ করেছেন। এবং সেসব আজ পর্যন্ত বহাল আছে। দৃষ্টান্ত থাকলে অনুসরণ করাই বিধেয় হবে।

কাজী হাবিবুল আউয়াল: প্রধান নির্বাচন কমিশনার

Share