জালিয়াতের কবল হতে কাকরাইলের মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রীর ভবন দখল মুক্ত হয়েছে

গাজী আবু বকর : রাজধানীর কাকরাইলে মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রীর আলোচিত ভবন জালিয়াতের কবল হতে অবশেষে মুক্ত হয়েছে। গত ৮ ও ২২ নভেম্বরের আদেশ অনুযায়ী বাড়িটি দখলমুক্ত না হওয়ায় গত ২৯ নভেম্বর মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করলে ৩০ নভেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার এর নির্দেশে পল্টন মডেল থানার ৪৬জন পুলিশ বাড়িটি দখলমুক্ত করে মুল মালিককে বুঝিয়ে দেন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার এর দপ্তরের স্মারক নং- ডিএমপি (স.দ)/লি.এ্যা./২-১৯/রিট ১৩৪/১১৪৮/৮২, তারিখ-২৮/১১/২০২১ খ্রিঃ ও স্মারক নং- ৫১৬০(৭)ডিসি (মতিঝিল), তারিখ-২৯/১১/২০২১ খ্রিঃ এর আলোকে স্মারক নং-৮৭৯৫/ওসি (পল্টন মডেল থানা) মুলে পল্টন মডেল থানার ওসি অপারেশনের নের্তৃত্বে ২জন এসআই, ১জন নারী এসঅই, ২জন এএসআই, ৩০জন পিওএম (রায়ট সামগীসহ) এবং ১০জন মহিলা কনস্টেবল গত ৩০নভেম্বর এই উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

গত ৮ নভেম্বর মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের পুর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ১০০৫/২০২০ এবং ২৩৬৪/২০২০ নং সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপীল এর উপর বিস্তারিত শুনানী শেষে এক অন্তর্বর্তী আদেশে ১৫ দিনের মধ্যে এই ভবনের পুর্ণাঙ্গ দখল বাড়ির মুল মালিক রোকসানা পারভীনের নিকট বুঝিয়ে দেবার জন্য ‘জালিয়াত নিলামক্রেতার’ প্রতি আদেশ দিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে ‘জালিয়াত নিলামক্রেতা’ ভবনের দখল বুঝিয়ে না দিলে রোকসানা পারভীনের নিকট ভবনের দখল বুঝিয়ে দেবার জন্য মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার এর প্রতি আদেশ জারি করেন।সেই আদেশ প্রতিপালিত না হওয়ায় আপীল বিভাগ ২২ নভেম্বর এবিষয়ে পরবর্তী আদেশ প্রদান করেন।সেই আদেশ প্রতিপালিত না হওয়ায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ ২৯ নভেম্বর তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করলে ৩০ নভেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার এর নির্দেশে পল্টন মডেল থানার ৪৬জন পুলিশ বাড়িটি দখলমুক্ত করে মুল মালিককে বুঝিয়ে দেন।উল্লেখ্য ঢাকার দেউলিয়া বিষয়ক আদালতে জাল নিলাম কার্যক্রমের মাধ্যমে চাঞ্চল্যকর আলোচিত ৬ তলা ভবন আত্নসাৎ করা হয়।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ও তপশিল সম্পত্তির বিবরণ জালিয়াতি করে রাজধানীর ৩৬/২ কাকরাইলে এক মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রীর আলোচিত ভবন গ্রাস প্রচেষ্টায় নিন্ম আদালতের জাল নিলাম ও নিলাম পরবর্তী দখল আদেশের বিরুদ্ধে রোকসানা পারভীন গত ২ মে ২০১৯ তারিখে মহামান্য সুপ্রিমকোটের হাইকোট বিভাগে ৫০৩৮/২০১৯ নং রিট দায়ের করলে বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ গত ৬ মে-২০১৯ তারিখে রুল জারি করেন। একই সঙ্গে দেউলিয়া আদালত কর্তৃক অনুমোদিত নিলাম ও নিলাম পরবর্তী কার্যক্রম স্থগিত আদেশ সহ বিবাদীদের বিরুদ্ধে নিষেধাঙ্গা জারি করেন।পরবর্তীতে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোট বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান মিঞা এবং বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীম এর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই জালিয়াতির বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রিট মামলায় পুর্ণাঙ্গ শুনানী গ্রহণ করেন। ঢাকার দেউলিয়া বিষয়ক আদালতের ৪/৯৯ নং মামলার সরকারি রিসিভার অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ সুলতান আহম্মেদ মিঞা এবং দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার ডেপুটি ম্যানেজার (বিজ্ঞাপন) আল-আমীন মহামান্য হাইকোটের নির্দেশে গত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে মহামান্য হাইকোটের উল্লেখিত বেঞ্চে স্ব শরীরে উপস্থিত হন। এ দু’জনকে স্ব শরীরে উপস্থিত হবার জন্য মহামান্য হাইকোট গত ১৯ জানুয়ারি ২০২০ প্রথম দফা এবং গত ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে দ্বিতীয় দফায় আদেশ দিয়েছিলেন।মহামান্য হাইকোটের নির্দেশ অনুযায়ী ঢাকার দেউলিয়া বিষয়ক আদালত এই মামলার মুল নথি হাইকোটের উল্লেখিত বেঞ্চে প্রেরন করেন।মহামান্য হাইকোট বিগত ১২ই মার্চ ২০২০ বৃহষ্পতিবার রায়ের নির্ধারিত দিনে রিটটি নিষ্পত্তি করে আদেশ ঘোষণা করেন।এ বিষয়ে দায়েরকৃত রিট মামলায় জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করেন। এই জালিয়াতির সাথে জড়িত এক অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজকে সরকারি রিসিভারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের করার জন্যেও হাইকোট নিন্ম আদালতকে নির্দেশ দেন।আদেশে মহামান্য হাইকোট নিলাম ক্রেতাকেেএক মাসের মধ্যে বাড়িটির দখল বাড়ির মূল মালিকের নিকট বুঝিয়ে দেবার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

আদেশে মহামান্য হাইকোট সরকারি রিসিভারকে তার নিকট গচ্ছিত নিলাম মূল্যের এক কোটি বিশ লাখ টাকার সাথে ৬ শতাংশ সুদ সহ সমুদ্বয় টাকা ঢাকার দেউলিয়া বিষয়ক আদালতে জমা প্রদানের নির্দেশ দেন।মহামান্য হাইকোট ঐ টাকা থেকে নিলাম ক্রেতার এক কোটি বিশ লাখ টাকা ফেরৎ প্রদানেরও নির্দেশ দিয়েছিলেন। মহামান্য হাইকোটের এই আদেশে দায়গ্রস্থ বাড়ির মালিককে ৬০ দিনের মধ্যে ব্যাংকের বকেয়া দেনা পরিশোধের সুযোগ প্রদান করা হয়।

মহামান্য হাইকোর্টের এই আদেশের বিরুদ্ধে দেউলিয়া বিষয়ক আদালত, ঢাকা এর চলমান মামলা নং-৪/১৯৯৯ এর সরকারি রিসিভার মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে ২৪ মার্চ ২০২০ তারিখে ৩৬২/২০২০ নং সি এম পি মামলা দায়ের করলে মহামান্য চেম্বার জজ মহামান্য হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ প্রদান করেন।

মহামান্য হাইকোর্টের ৫০৩৮/২০১৯ নং রিট মামলার পূর্ণাঙ্গ আদেশ ‘জালিয়াত নিলামক্রেতা’ গত ৫ আগষ্ট ২০২০ তারিখ বেলা ২টায় গ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি পুনরায় ‘জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে গত ১৭ আগষ্ট ২০২০ তারিখে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের মহামান্য চেম্বার জজ আদালতে ১০০৫/২০২০ নং সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপীল দাখিল করিলে মহামান্য চেম্বার জজ সকল পক্ষের উপর স্থিতিবাস্থার আদেশ দেন ।

মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতের আদেশ মোতাবেক সরকারি রিসিভার বিগত ২১ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে ২৩৬৪/২০২০ নং সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপীল মামলা দায়ের করেন।

রিটের আরজিতে বলা হয়, আলোচিত এই ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানী ঢাকার ৩৬/২ কাকরাইলে। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক মেসার্স নিয়াজ গার্মেন্টস এর অনুকুলে ১৯৯৫ সালে ৩৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ঋণ প্রদান করে। এই ঋনের অনুকুলে কোম্পানী কাফরুল থানায় স্থাপিত কোম্পানির কারখানা ব্যাংকের অনুকুলে মটগেজ প্রদান করেন। পরবর্তীতে কোম্পানি রুগ্ন হয়ে যায়। ফলে সময় মত ঋন পরিশোধ না করায় ব্যাংক অনাদায়ী ঋণের সুদাসল ৫৩ লাখ ২২ হাজার টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে ১৯৯৯ সালে কোম্পানির বন্দককৃত সম্পত্তি নিলাম করে টাকা আদায়ের চেষ্টা না, করে কোম্পানী ও তার পরিচালকদের দেউলিয়া ঘোষনা করাতে ঢাকার দেউলিয়া বিষয়ক আদালতে ৪/১৯৯৯ নং মামলা দায়ের করেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের মামলায় ঐ কোম্পানির ৪০% শেয়ার হোল্ডারধারী চেয়ারম্যান রোকসানা পারভীনের বসত বাড়ীটিই শুধু দেউলিয়া আদালতের “বি” তপশিলে দেখান। কিন্তু অন্য পরিচালকদের কোন সম্পত্তির বিবরণ দেননি। অবশেষে ২০০৮ সালে কোম্পানি ও তার ৪ জন পরিচালককে দেউলিয়া ঘোষনা করা হয়। আদালত কর্তৃক রোকসানা পারভীনের “বি” তপসিল বর্ণিত সম্পত্তি বিক্রয় করে ব্যাংকের টাকা আদায়ে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ সুলতান আহম্মেদ মিঞাকে রিসিভার নিয়োগ করা হয়। রোকসানা পারভীনের স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সেনা বাহিনীর অবসর প্রাপ্ত মেজর, কাজী মাজেদুর রহমান ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর মারা যাওয়ার পর সরকারি রিসিভার অসহয় ঐ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের “বি” তপসিল বর্ণিত সম্পত্তি নিলামে বিক্রয় করার জন্য ১৩ মে ২০১৫ তারিখের জাতীয় দৈনিক যুগান্তর ও দৈনিক খবর পত্রিকা আদালতে পেশ করেন। পেশকৃত ঐ দু’টি পত্রিকায় দরপত্র আহবানের নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ দেখানো হয়। অথচ উল্লেখিত দু’টি পত্রিকার বর্ণিত ১৩ মে ২০১৫ তারিখের প্রকাশিত মূল পত্রিকার কোন সংস্করণ ও কোন সংখ্যায় এ ধরনের কোন নিলাম দরপত্রের বিজ্ঞপ্তিই প্রকাশিত হয়নি। উপরন্ত এই জাল জালিয়াতির নিলামে ঐ আড়াই কাঠা সম্পত্তির উপরে থাকা ভবনের কথা গোপন করে কারসাজির মাধ্যমে ১৫ কোটি টাকার সম্পদ ১ কোটি ২০ লাখ টাকায় নিলাম বিক্রয় আদালতের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। অতঃপর জালিয়াত নিলাম গ্রহিতার অনুকুলে ঐ আড়াই কাঠা জমি হস্তান্তর বাবদ ঢাকা সাব রেজিঃ অফিসে ১৮১৩/১৬ নং দলিল সম্পাদন করা হয়। ঐ দলিলেও ৬ তলা ভবনের কথা গোপন করা হয়। এ ক্ষেত্রে ঘোষিত দেউলিয়ার অব্যাহতি প্রাপ্ত সম্পত্তির আইনগত অধিকারের ক্ষেত্রেও জালিয়াতি করা হয়। অতঃপর সরকারি রিসিভারের সহকারি জনৈক আহসান হাবিব ২২ জুন-২০১৭ তারিখে ঘটনাস্থলে নিজেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয় দিয়ে পুলিশ ও শত শত লাঠিয়াল বাহিনী সহায়তায় জাল নিলামকৃত আড়াই কাঠা জমির দখল নিলাম গ্রহিতার অনুকুলে বুঝিয়ে দিতে এসে ৬ তলা ভবনসহ তপসিল বর্ণিত জমির দখল বুঝিয়ে দেন।

Share