সৌদি আরব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে প্রবাসী আয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আধিপত্য

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : দেশের প্রবাসী আয়ে দীর্ঘদিন বড় অবদান রেখে আসছে সৌদি আরব। গত দুই অর্থবছরে (২০২১-২২ ও ২০২২-২৩) প্রবাসী আয়ে শীর্ষে ছিল যথাক্রমে সৌদি আরব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সদ্য বিদায়ী অর্থবছর (২০২৩-২৪) দাপট দেখিয়ে সবাইকে পেছনে ফেলে আধিপত্য বিস্তার করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। বিষয়টি নিয়ে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

অবৈধভাবে আরব আমিরাতে টাকা পাচারের অভিযোগ অনেক পুরোনো। এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। আবার কেউ বলছেন, বর্তমানে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় আসা কমেছে, বিপরীতে ইউএই ও যুক্তরাজ্য থেকে বেড়েছে। এ কারণে দেশভিত্তিক প্রবাসী আয়ে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে গত দুই বছরে দেশভিত্তিক তৃতীয় অবস্থানে ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ের দিক থেকে শীর্ষে ছিল সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি থেকে ওই অর্থবছর প্রবাসী আয় এসেছিল ৪৫৪ কোটি ১৯ লাখ ডলার, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩৪৩ কোটি ৮৪ লাখ ডলার ও আরব আমিরাত থেকে আসে ২০৭ কোটি ১৮ লাখ ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও শীর্ষে ছিল সৌদি আরব। অর্থবছরটিতে দেশটি থেকে এসেছিল ৩৭৬ কোটি ৫২ লাখ ডলার, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩৫২ কোটি ২০ লাখ ডলার এবং আরব আমিরাত থেকে ৩০৩ কোটি ৩৮ লাখ ডলার।

সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে হঠাৎ করেই সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে শীর্ষ উঠে এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরব আমিরাত থেকে প্রবাসী আয় এসেছে ৪৫৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছর থেকে ১৫৬ কোটি ৫২ লাখ ডলার বেশি। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ২৯৬ কোটি ১৬ লাখ ডলার এবং সৌদি আরব থেকে ২৭৪ কোটি ১৫ লাখ ডলার।

তথ্য বলছে, এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ১৬৩ কোটি ৭৪ লাখ ও সৌদি আরবের চেয়ে ১৮৫ কোটি ৭৫ লাখ ডলার বেশি এসেছে।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্র জানায়, ২০০৪ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রায় ২১ লাখ ৫৮ হাজার কর্মী কাজের খোঁজে প্রবাসী বাংলাদেশিরা সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছেন। একই সময়ে সৌদি আরবে যান ৩৮ লাখ ৮৫ হাজার কর্মী, যা সৌদির তুলনায় ৪৪ শতাংশ কম।

একটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বলেন, অনেক বাংলাদেশির দুবাই এখন আকর্ষণীয় গন্তব্য। অনেকেই দেশটিতে বাড়ি কিনছেন। দেশে ডলার সংকট হওয়ায় মার্কিন মুদ্রাটির দামও বেড়েছে। আবার ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে প্রণোদনা পাচ্ছেন। এসব কারণে আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স বেশি আসার একটি কারণ হতে পারে। এরপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবশ্যই দেখার আছে।

রেমিট্যান্স বেড়ে যাওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘রেমিট্যান্স বাড়ার মূল কারণ হলো ডলারের ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের সঙ্গে ব্যাংকের দরে পার্থক্য কমে আসা। এতে বৈধপথে উৎসাহিত হচ্ছেন প্রবাসীরা। আবার বর্তমান পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ ব্যাংক রেমিট্যান্স বাড়াতে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। ব্যাংকগুলো প্রবাসীদের কাছে গিয়ে উৎসাহিত করছে। এতে রেমিট্যান্স বাড়ছে, আগামীতে আরও বাড়বে বলে আশা করি।’

খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সংকটময় পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়া দেশের জন্য সুসংবাদ। এটা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ হেলদি করবে, এটা অর্থনীতির জন্য ভালো। আবার এটাও দেখতে হবে যে, অবৈধভাবে অর্থপাচারের নিরাপদ রুট মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। পাচার হওয়া টাকার ওপর প্রণোদনা ও বৈধতা নিতে তা রেমিট্যান্স আকারে দেশে ফিরে আসছে কি না সেটাও দেখার বিষয়।

প্রবাসী আয় আহরণে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে- আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, ওমান, ইতালি, কুয়েত, কাতার এবং সিঙ্গাপুর। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে মালয়েশিয়া থেকে এসেছে ১৬০ কোটি ৭৭ লাখ ডলার, যুক্তরাজ্য থেকে ২৭৯ কোটি ৩২ লাখ ডলার, ওমান থেকে ১১২ কোটি ৩৪ লাখ ডলার, ইতালি থেকে ১৪৬ কোটি ১৬ লাখ ডলার, কুয়েত থেকে ১৪৯ কোটি ৬৬ লাখ ডলার, কাতার থেকে ১১৪ কোটি ৯৯ লাখ ডলার ও সিঙ্গাপুর থেকে ৬৩ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার ডলারের রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়।

হঠাৎ কোনো একটি দেশ থেকে রেমিট্যান্স বেড়ে যাওয়া বিষয়ে কথা হয় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই সময়ে রেমিট্যান্স বেড়ে যাওয়া ভালো, বিনিময় হারের জন্যও ভালো। ফলে রিজার্ভ ইতিবাচক ধারায় ফিরবে। তবে দেখা দরকার কোন সোর্স থেকে আসছে, পরিবর্তনের কারণটা কী। পাচার হওয়া টাকার ওপর প্রণোদনা ও বৈধতা নিতে তা রেমিট্যান্স আকারে দেশে ফিরে আসছে কি না সেটাও বাংলাদেশ ব্যাংককে খতিয়ে দেখতে হবে।’

এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘সৌদি আরবে আমাদের ২৬-২৭ লাখ কর্মী গেলো। এরপরও রেমিট্যান্স কমলো কেন। সৌদি আরব থেকে আগের মতো কেন বেশি বেশি আর আসছে না। অন্য শীর্ষ দেশ থেকেও কেন আগে যেটা আসতো, সেটা এখন আসছে না, এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না বাংলাদেশ ব্যাংককে দেখতে হবে। আয় বাড়াতে কোনো পদক্ষেপ নিতে হলে সেটাও নিতে হবে।’

Share