চাকরি, টিউশনি করেও মানসুরার ঈর্ষণীয় ফল

কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধি : বাবা প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। তিনি কাজ করতে না পারলে আটার রুটি ও ডাল-সবজি খেয়ে দিন কাটাতে হতো। বাবার আয়ে পড়াশোনা চালানোর মতো অবস্থা ছিল না। তাই টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছে সে। সেখান থেকে কিছু টাকা সংসারেও দিয়েছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যা পড়াতেন, সেটাই বাসায় অনুশীলন করত। বাড়তি শিক্ষক বা কোচিং সেন্টারে পড়ার সামর্থ্য ছিল না। এই করেই মানসুরা আক্তার এবার এসএসসিতে কারিগরি বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে।

ঢাকার কেরানীগঞ্জের জিনজিরা পীর মোহাম্মদ পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সে। তার স্বপ্ন প্রকৌশলী হওয়ার। কিন্তু অভাব-অনটনের কারণে মানসুরার ভবিষ্যতের পড়ালেখা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

মানসুরা আক্তার বলে, ‘প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠতাম। এরপর ফজরের নামাজ পড়ে পড়তে বসতাম। সকাল আটটার দিকে পান্তাভাত বা বিস্কুট খেয়ে স্কুলে যেতাম। দুপুর ১২টায় স্কুল ছুটি হলে তিন কিলোমিটার হেঁটে গোলামবাজার এলাকায় একটি দোকানে কাজে যেতাম। টাকা থাকলে দুপুরে মাঝেমধ্যে রুটি-বিস্কুট কিনে খেতাম। সেখান থেকে প্রতিমাসে চার হাজার টাকা বেতন পাই। এরপর বিকেল পাঁচটার দিকে সেখানে থেকে দুই কিলোমিটার হেঁটে শুভাঢ্যা এলাকায় পাশাপাশি দুটি বাড়িতে টিউশনি করাতাম। রাত আটটার দিকে টিউশনি করে বাসায় ফিরতাম। এরপর রাত ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত নিজের পড়ালেখা করতাম।’

বৃহস্পতিবার কেরানীগঞ্জের কালিন্দী ইউনিয়নের ভাংনা এলাকায় শামসুল ইসলাম কলোনিতে মানসুরাদের ভাড়া বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, মানসুরা আধা পাকা টিনশেডের ছোট একটি ঘরে মাদুর পেতে বসে ভর্তি পরীক্ষার বই পড়ছে। ঘরের এক কোণে যৎসামান্য আসবাব। পাশে জরাজীর্ণ একটি শোকেস।

ঘরে কথা হয় মানসুরার মা তাছলিমা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে প্রথম শ্রেণি থেকেই ভালো ফল করত। ২০১৫ সালে চড়াইল নুরুল হক উচ্চবিদ্যালয় থেকে মানুসরা অষ্টম শ্রেণি পাস করে। এরপর টাকার অভাবে আর পড়াশোনা করাতে পারিনি। প্রায় তিন বছর মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ থাকে। ২০১৯ সালে মেয়ে আমাকে জানায়, সে নিজে টিউশনি করে নিজের পড়ালেখার খরচ জোগাবে। ওই বছর জিনজিরা পীর মোহাম্মদ পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়।’

তাছলিমা আরও বলেন, ‘আমার স্বামী পুরান ঢাকার নয়াবাজারে ঠেলাগাড়ি চালান। যেদিন কাজে যান সেদিন ঘরে বাজারসদাই আসে। কাজে গেলে প্রতিদিন ৫০০-৬০০ টাকা আয় করতে পারেন। যেদিন কাজে যেতে পারেন না, সেদিন প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধারকর্জ করে চলতে হয়। প্রতিমাসে ঘরভাড়া দিতে হয় দুই হাজার টাকা। সংসার খরচ ১০-১২ হাজার টাকা। একটিমাত্র মেয়ে। সংসারের হাল ধরার মতো কেউ নেই। মেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় ভালো করেছে। কিন্তু মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’

তাছলিমা বলেন, ‘আমাদের তো টাকাপয়সা নেই যে মেয়েকে কলেজে ভর্তি করাব। এখন কলেজে ভর্তি হতে গেলে অনেক টাকা প্রয়োজন। বয়সের ভারে ওর বাবা আগের মতো কাজকর্ম করতে পারেন না। এ অবস্থায় ভবিষ্যতে মেয়ের পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না।’

মানসুরাদের প্রতিবেশী আফজাল হোসেন বলেন, মানসুরা খুবই পরিশ্রমী। সে পড়াশোনার পাশাপাশির চাকরি আর টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ চালাত। ওদের খুব করুণ অবস্থার মধ্যে দিয়ে দিন যাচ্ছে। মেয়েটি সকালে ঘর থেকে বের হয়ে রাতে বাসায় ফিরত। এভাবে সে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তিনি বলেন, মানসুরা দারিদ্র্যের কাছে হার মানেনি, সে মেধা দিয়ে দারিদ্র্য জয় করেছে। পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারলে সে অনেক দূর যাবে।

জিনজিরা পীর মোহাম্মদ পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু রায়হান বলেন, মানসুরা তাঁদের বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী। নবম শ্রেণি থেকে বিদ্যালয় থেকে তাঁকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হতো। মানসুরা এসএসসিতে ভালো ফল করেও দুশ্চিন্তায় আছে। অর্থের অভাবে সামনে পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়া নিয়ে সংশয়ে আছেন।

Share