দয়ালের ডাকে চিরতরে চলে গেলেন এন্ড্রু কিশোর

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : “ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে-রইবো না আর বেশদিন তোদের মাঝারে” দীর্ঘ ১০ মাস ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে গিয়ে পরকালের ডাকে প্রস্থান করেছেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। তিনি তার গানের এই বাণীর সাথে আজ সন্ধ্যায় চির সন্ধি করে নিয়েছেন।সিঙ্গাপুরে চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি নিজের ইচ্ছায় দেশে ফিরতে চেয়েছেন। বলেছিলেন, ‘আমি আমার দেশে গিয়ে মরতে চাই, এখানে নয়।’ ১১ জুন বিকেলে সিঙ্গাপুর থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে ফেরেন তাঁরা। ফিরে যান রাজশাহীতে, যেখান থেকে শুরু। নিজের শহর রাজশাহীর মহিষবাথান এলাকায় বোনের বাড়িতে শেষ হলো তাঁর জীবনের গল্প, পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিলেন তিনি। সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।সেই কবে দেখা হয়েছিলো,কথা হয়েছিলো, হয়েছিলো মন বিনিময়-তারপর কেটে গেছে কতনা বছর, আজো আমি খুঁজি যে তোমায়।তাঁর গানের এই মর্ম বাণীর মতো তাঁর ভক্তকুল এখন থেকে তাঁকে শুধু খুঁজেই ফিরবে।

শরীরে নানা ধরনের জটিলতা নিয়ে অসুস্থ অবস্থায় গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১৮ সেপ্টেম্বর তাঁর শরীরে নন-হজকিন লিম্ফোমা নামক ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়ে। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক লিম সুন থাইয়ের অধীনে তাঁর চিকিৎসা শুরু হয়। সেখানে কয়েক মাস একনাগাড়ে তাঁর চিকিৎসা চলে। সব চেষ্টার ব্যর্থ করে চিরতরে বিদায় নেন তিনি।

অবশ্য মাঝে চিকিৎসায় কিছু সাড়া মেলে। এ বছরের এপ্রিলে সেসব শেষ করে চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, এখন আর দরকার নেই, শুধু ওষুধ খেতে হবে। দেশে ফিরে যেতে পারবেন এন্ড্রু কিশোর। তাঁর স্ত্রী জানান, মে মাসের ১৩ তারিখ দেশে ফেরার টিকিট কেনা হয়েছিল। কিন্তু এন্ড্রু কিশোর শারীরিকভাবে ভীষণ দুর্বল বোধ করছিলেন। তাই বাতিল করা হলো টিকিট। চিকিৎসক জানিয়েছেন, এই দুর্বলতা কেমোর ধকল। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। চিকিৎসক আশ্বস্ত করায় ১০ জুন ফেরার টিকিট কেনা হয়েছিল। কিন্তু ২ জুন হঠাৎ আবার অসুস্থ হয়ে যান শিল্পী। পরদিন রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় ৪ জুন। কোনো ওষুধই আর কাজ করছিল না শরীরে। পিইটি স্ক্যান হয় ৯ জুন। সে রিপোর্টে দেখা গেল লিম্ফোমা ভাইরাস ডান দিকের লিভার ও স্পাইনালে ছড়িয়ে গেছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গাতেও অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিলেন, আর কিছুই করার নেই।

বাংলা গানের এই কণ্ঠশিল্পী ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের আধুনিক ও চলচ্চিত্রজগতের কালজয়ী অনেক গান তাঁর কণ্ঠে সমৃদ্ধ হয়েছে। সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দ, প্রেম-বিরহ—সব অনুভূতির গানই তিনি গেয়েছেন। ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর তিনি রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এন্ড্রু কিশোর প্রাথমিকভাবে আবদুল আজিজ বাচ্চুর অধীনে সংগীতের পাঠ শুরু করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর কিশোর নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, আধুনিক, লোক, দেশাত্মবোধকসহ প্রায় সব ধারার গানে রাজশাহী বেতারে তালিকাভুক্ত হন। চলচ্চিত্রে এন্ড্রু কিশোর গান গাওয়া শুরু করেন ১৯৭৭ সালে। ছবির নাম ‘মেইল ট্রেন’। পরিচালক শিবলী সাদিক। এই ছবিতে তিনি গেয়েছিলেন ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানটি। চলচ্চিত্রে এটাই ছিল তাঁর প্রথম গান। সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন আলম খান। কিন্তু এন্ড্রু কিশোর সবার কাছে পৌঁছে যান দুই বছর পর। তাঁর এই গান ছিল ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’। মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা গানটির সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন আলম খান।

দীর্ঘদিন পুরোদস্তুর পেশাদার কণ্ঠশিল্পী হিসেবে দুই বাংলায় গান করেছেন এন্ড্রু কিশোর। একের পর এক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন তিনি।

গেল বছরের সেপ্টম্বর মাসে অসুস্থ হয়ে পড়ার আগপর্যন্ত এন্ড্রু কিশোর প্লেব্যাক ও স্টেজ শো নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। আলম খানের সুর-সংগীতে গেয়েছেন প্রয়াত সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হকের লেখা শেষ তিনটি গান। এন্ড্রু কিশোর দেশের প্রখ্যাত সুরকারদের মধ্যে বেশি গান করেছেন আলম খান, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আলাউদ্দিন আলীর সঙ্গে। এ ছাড়া গান করেছেন শেখ সাদী খান, ইমন সাহা, আলী আকরাম শুভ, অশোক পালসহ অনেকের সঙ্গে। ভারতের প্রখ্যাত সুরকার আর ডি বর্মনের সুরেও গান গেয়েছেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে কলকাতাতেও প্লেব্যাকে বেশ কয়েকটি গান করেছেন।

মাঝে কিছুদিন ব্যবসাও করেছিলেন। ১৯৮৭ সালে এন্ড্রু কিশোর আহমাদ ইউসুফ, আনোয়ার হোসেন বুলু, ডলি জহুর প্রমুখের সঙ্গে টিভি নাটক, বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য প্রযোজনার জন্য ‘প্রবাহ’ নামে একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান শুরু করেন।

এন্ড্রু কিশোরের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যিখানে’, ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে’, ‘তুমি আমার জীবন আমি তোমার জীবন’, ‘ভালো আছি ভালো থেকো’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু ভালোবাসা পেলাম না’, ‘তুমি আমার কত চেনা’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘তোমায় দেখলে মনে হয়’,‘এইখানে দুইজনে নির্জনে’সহ অনেক গান। জীবনের বেশির ভাগ সময়ে মূলত চলচ্চিত্রে গান করেই কাটিয়েছেন। চলচ্চিত্রের এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে অডিও বাজারে খুব একটা অ্যালবাম করেননি। চলচ্চিত্রের বাইরে এসে প্রথম দিকে তিনি ইত্যাদিতে গান করেন ‘পদ্মপাতার পানি নয়’, যা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার ইত্যাদিতে এসেছেন।

এন্ড্রু কিশোরের এক ছেলে ও এক মেয়ে। তাঁরা দুজনেই অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। মেয়ে মিনিম এন্ড্রু সংজ্ঞা সিডনিতে গ্রাফিক ডিজাইন ও ছেলে জে এন্ড্রু সপ্তক মেলবোর্নে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়াশোনা করছেন।

Share