বাংলা নববর্ষ : “বর্ষবরণ শোভাযাত্রা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রার” ইতিহাস

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : যশোহর থেকে ঢাকায়। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০। হীরন্ময় চন্দ্র ও মাহবুব জামাল শামীম এর “বর্ষবরণ শোভাযাত্রা” কালের পরিক্রমায় রুপ নিলো “মঙ্গল শোভাযাত্রায়”।

ফুল ও পশু-পাখির প্রতীতি হাতে হাজারো মানুষের কলতান; আবহ সঙ্গীতে কালবৈশাখী ও শ্রেষ্ঠাংশে চৈত্র সংক্রান্তি। এভাবেই বর্তমাানে নববর্ষকে “মঙ্গল শোভাযাত্রা” শিরোনামে বাংলার সরণীকে রঙিন করে স্বাগতম জানানো হয়। সহস্র পদব্রজের প্রতিধ্বনিতে অনুরণিত হতে থাকে ধর্ম ও বর্ণের বৃত্ত ভাঙার শব্দ। প্রতিটি পাড়া থেকে শহুরে রাজপথ; ধুলোয় ধূসরিত বাঙালির গন্ড থেকে বাংলা সংস্কৃতি; মিলে মিশে একাকার হয় এক মঞ্চে। এরই চিত্রপট জুড়ে থাকে তিন যুগের পুরোনো এই আনন্দ মিছিলের ইতিহাসের কথা। বাঙালি ঐতিহ্যের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের পর্বগুলো নিয়েই আজকের ফিচার।

মঙ্গল শোভাযাত্রা কি এবং কেন : প্রত্যেক বছর বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নেয়ার মহোৎসব এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। এর আয়োজনে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকবৃন্দ। এই শোভাযাত্রার বিস্তৃতি ঢাকার প্রাণকেন্দ্র শাহবাগ, রমনা ও এর আশেপাশের এলাকা নিয়ে।

বৈশাখের প্রথম দিনে এই আনন্দ মিছিলটি নিমেষে পরিণত হয় বাংলার সর্বস্তরের ও বিভিন্ন বয়সের মানুষের মহা সম্মেলনে। উৎসবের সব থেকে চোখ জুড়ানো বিষয়টি হচ্ছে বিভিন্ন ফুল, পশু-পাখি ও রূপকথার চরিত্রের রঙ-বেরঙের শিল্পকর্ম।

নিছক আনন্দ মিছিল ছাড়াও মঙ্গল শোভাযাত্রার নেপথ্যে রয়েছে নতুন বছরে সকল অপশক্তির অবসানপূর্বক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ঐক্যতার প্রত্যয়।

প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার গল্প : সময়টা ছিল ১৯৮৫ সাল; বাংলা ১৩৯২ সন। যশোরের বেসরকারি সংগঠন চারুপীঠ-এর কর্মীরা বেরিয়ে পড়লেন পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নিতে। অনেক ভোরে যশোর পুরনো কলেজ প্রাঙ্গণ জুড়ে চারুপীঠের পলাশ মস্কন্দ পরিণত হয় প্রায় একশ তরুণ ও তিনশ শিশুর মিলনমেলায়।

বর্ষবরণের শোভাযাত্রার মাথার উপর দিয়ে চোখে পড়ে হরেক রকমের শিল্পকর্ম। রঙিন মুকুট পরা রাজকুমার ও রাজকুমারি, পরী, পেখম মেলা ময়ুর, ফুল, প্রজাপতি ও রাঙা টোপড়ের টিয়া। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, দৈত্য-দানো আর ভূতুড়ে-অদ্ভূতুড়ে মুখোশগুলো চমকিত মুখ যেন ভেঙচি কাটছিল। ছোট্ট দলটির কুচকাওয়াজ যেন পিচঢালা রাজপথ জুড়ে ছোট ছোট রঙের ফোয়ারা।

ভোর ৬টায় যশোরের আকাশে মিষ্টি রোদের রেখায় সানাইয়ের সুর ও বাদ্যের তালে এগিয়ে যেতে থাকলো আনন্দ শোভাযাত্রা। শহর প্রদক্ষিণের পরেও চারুপীঠের থামার নাম নেই। অবিরাম সে পথচলা যেন শেষ হওয়ার নয়। সূর্যালোক পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত শহরের প্রতিটি মোড় প্রাণবন্ত করে তুলেছিল সেদিন নববর্ষের রবে।

১৯৮৫-এর আয়োজনের জনপ্রিয়তায় যশোরের নানা সংগঠন থেকে আক্ষেপ আসে- কেন সবাই আমন্ত্রিত হয়নি! এরই অঙ্কুরে পরের বছরেই যশোরের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগে বর্ষবরণ উদযাপনের সিদ্ধান্ত হয়। এমনকি সবার উদ্দেশ্য থাকে কার্যকলাপটিকে সামাজিক উৎসবে রূপদান করার।

পরিকল্পনা মোতাবেক চারুপীঠের কর্মীরা ছড়িয়ে পড়তে থাকে ত্রি-সীমানার লোক-ঐতিহ্যের সম্ভ্রান্ত অঞ্চলগুলোতে। অতি যতনে উত্তোলন করা হয় শত বছরে দৌলতপুরের মাটির পুতুল শিল্প, শালিকার শোলার শিল্প, এবং নড়াইলের পুতুল ও মৃৎশিল্পকে।

১৯৮৬ সাল (বাংলা ১৩৯৪)-এর বৈশাখ আসতে তখনো অনেক বাকি। সারাবছর ধরে করা পরিকল্পনাগুলো বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করলো। এ সময়ের তৈরি করা মুকুট, শোলার পাখায় রঙিন নকশা আঁকা মুখোশগুলো পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রেওয়াজে পরিণত হয়।

যশোরের সকল সাংস্কৃতিক সংগঠন একসাথে হয়ে গঠন করে যশোর বর্ষবরণ পরিষদ। তখন বর্ষবরণ শোভাযাত্রা শুধু চারুপীঠের রইলো না; হয়ে গেলো সবার মিলিত আয়োজন। এর ফলেই পরবর্তীতে দেশব্যাপী এ উৎসবকে সবাই নিজের উৎসব হিসেবে উদযাপন করতে পারে।

উৎসবের যাবতীয় কর্মযজ্ঞের কেন্দ্র ছিল যশোরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান যশোর ইনস্টিটিউট। এই প্রতিষ্ঠানটির কল্যাণেই বর্ষবরণ শোভাযাত্রা দ্বিতীয় প্রয়াসেই মহোৎসবে পরিণত হতে পেরেছিল। সেই দিন শোভাযাত্রার অংশগ্রহণকারি ছিল যশোরের সাড়ে তিন হাজার মানুষ। সবার মাথায় সেই বর্ণাঢ্য মুকুট আর দলগুলোতে ৩০টি করে শোলার পাখা। বিরাটকায় পাপেট হাতির কান নাড়িয়ে শূঁর দুলিয়ে গলায় ঘন্টা বাজিয়ে হেটে চলা আকৃষ্ট করছিল চারপাশের পথচারিদের। আরও ছিল বিশাল কুমিরের লাল মুখো মাপেট। মুখ হাঁ করে সাদা দাঁতের সারি দেখিয়ে মিছিলের মাঝ দিয়ে এঁকে-বেঁকে হেঁটে চলছে। ৪০ জন বাংলা ঢাক সানাইয়ের বাদ্যদল ১০ জন করে ভাগ হয়ে শোভাযাত্রায় সুর ও তালে নৃত্যের আমেজ সৃষ্টি করছিল। শালিকার লোকজ ঐতিহ্যের ১০টি বৃহদাকার শোলার বানর পাপেট লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল পুরো শোভাযাত্রা জুড়ে।

বর্ষবরণ শোভাযাত্রাটি চারুপীঠ থেকে শুরু হয়ে শহর ঘুরে ফিরে এসেছিল যশোর ইনস্টিটিউটে। অতঃপর সেখানে বৈশাখী মেলার উদ্বোধনের মাধ্যমে ইতি টানা হয়েছিল বর্ষবরণ উৎসবের। শোভাযাত্রা সমেত পুরো অনুষ্ঠানটিকে ক্যামেরা বন্দি করেছিলেন ফাদার মাচ্চেল্য। যশোর ক্যাথলিক গির্জার এই পুরোহিত একজন ইতালীয় চিত্রকর ছিলেন।

যশোরের এই বর্ষবরণ শোভাযাত্রার উদ্যোক্তা হীরন্ময় চন্দ্র ও চারুপীঠের প্রতিষ্ঠাতা মাহবুব জামাল শামীম ১৯৮৮ সালে উচ্চতর শিক্ষালাভের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। তার পরের বছরেই চারুকলার শিক্ষার্থীদের আয়োজনে বের করা হয় ঢাকার প্রথম বর্ষবরণ শোভাযাত্রা। এরপরের বছর থেকে ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ও বরিশালসহ সারাদেশে।

১৯৯০ সালে ভাষাসৈনিক ইমদাদ হোসেন ও সঙ্গীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হকের পরামর্শে বর্ষবরণ শোভাযাত্রা নাম পাল্টে রাখা হয় “মঙ্গল শোভাযাত্রা।”

১৯৯১ সালে এই নাম নিয়ে চারুকলার আয়োজিত শোভাযাত্রাটি নতুন মাত্রায় পৌঁছে যায়। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এতে যোগদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর সহ অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকা, এবং দেশের প্রখ্যাত শিল্পী ও বিশিষ্ট লেখকবৃন্দ। ছোট-বড় নানা উপকরণ সহ ফুল ও পশু-পাখির প্রতিকৃতির কারুকর্মগুলো অব্যাহত থাকে।

এই প্রথা অনুসরণ করে ১৯৯৪ সালে নববর্ষের শোভাযাত্রা আয়োজন করা হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতন ও বনগাঁ শহরে। এরপর বাংলা নববর্ষ উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে ২০১৭ সাল থেকে নিয়মিত কলকাতায় মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয়। যার ধারাবাহিকতায় শোভাযাত্রা আয়োজিত হয়েছে ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২১ সালে। গাঙ্গুলিবাগান থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাপীঠ ময়দান অব্দি বিস্তৃত থাকে কলকাতার মঙ্গল শোভাযাত্রা। বর্তমানে এটি বিশ্বজুড়ে বাঙালিদের জাতীয় মহোৎসব।

২০০৫ থেকে ২০০৬ অর্থ বছরে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির তত্ত্বাবধানে বাংলা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ গৃহীত হয়। ১২টি খণ্ডে প্রকাশিত এই সমীক্ষা প্রতিবেদনের একাদশ খণ্ডের বিষয়বস্তু ছিল পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে জাতীয় সংস্কৃতিকরণ। বাংলাদেশ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাংলা একাডেমি এ প্রস্তাবটি সর্বপ্রথম উত্থাপন করেছিল ২০১৪ সালে। কিন্ত তা বাতিল হলেও পরবর্তীতে ২০১৫ সালে ১ জুন জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেস্কোর চাহিদা অনুযায়ী প্রস্তাবনাটিকে পুনরুত্থাপন করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি ইউনেস্কোর কাছে দাখিল করেন প্যারিসে কর্মরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম. শহিদুল ইসলাম।

ইউনেস্কো বাংলাদেশ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনটি পুনঃবিবেচনায় আনে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ (বাংলা ১৪২৩)-এ। ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা’য় ২০১৬-এর ২৮ নভেম্বর থেকে শুরু করে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ দিন ব্যাপী ইউনেস্কোর সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবনাটি অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার জন্য আন্তঃসরকার কমিটি কর্তৃক অনুমোদন করা হয়। সর্বসাকুল্যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর (বাংলা ১৪২৩ বঙ্গাব্দের ১৫ অগ্রহায়ণ)।

শেষাংশ : বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা সবার ওপর একজন মানুষ হিসেবে বাঙালির সম্মেলনের ধারক ও বাহক। ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী থেকে শুরু করে গোটা এক জাতির অস্তিত্ব নির্ভর করে তার সংস্কৃতির উপর। এই পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্ব দরবারে বাঙালিকে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে সগর্বে তুলে ধরে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিশ্ব নাগরিকদের অবাক চাহনির সামনে তাই আরও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে বৈচিত্র্যপূর্ণ এই বাংলা সংস্কৃতি।

Share