ভ্রাম্যমাণ আদালতের অপব্যবহার চলছেই

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : হাইকোর্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করেছেন ৫ বছর আগে। তবে এমন আদালত পরিচালনার বৈধতার প্রশ্নটি এখনো অমীমাংসিত। ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেছে ২০১৭ সালে। বর্তমানে এটি বিচারাধীন দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ রয়েছে। এই সুযোগে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত (মোবাইল কোর্ট) পরিচালিত হচ্ছে। তবে এর অপব্যবহার থেমে নেই। ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের অপব্যবহারের কারণে গত ২৫ নভেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে দুই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বিচারিক ক্ষমতা স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট।

অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে আমলে নিয়ে, উপস্থিত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সংক্ষিপ্ত বিচারের জন্য মোবাইল কোর্ট অধ্যাদেশ জারি করা হয় ২০০৭ সালে। ২০০৯ সালে সেটা আইনে পরিণত হয়। এই আইনের অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত জেলা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তপশিলে উল্লিখিত কিছু অপরাধের সংক্ষিপ্ত বিচার করেন। আইনটি হওয়ার পর থেকে মোবাইল কোর্টের অনেক কাজ প্রশংসিত হয়েছে। তবে এই আইন যেসব শর্ত দিয়ে অপরাধ আমলে নিতে বলেছে, সেটা নির্বিচারে লঙ্ঘিত হচ্ছে। অথচ কতিপয় অপরাধের তাৎক্ষণিক বা দ্রুত বিচার জরুরি বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু সেই প্রয়োজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা পূরণ করতে পারছেন না। তারা অনেক সময় নিজেদের স্বার্থে ইচ্ছা মতো আইনটির ব্যবহার করছেন। ফলে বারবার আইনটির অপব্যবহারের অভিযোগ উঠছে।

আইনটির ৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সংঘটিত বা উদ্ঘাটিত হলে তিনি ওই অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই আমলে নিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে, স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে, দোষী সাব্যস্ত করে নির্ধারিত দণ্ড আরোপ করতে পারবেন। কিন্তু এর অহরহ লঙ্ঘন ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রেই ম্যাজিস্ট্রেটরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত না হয়েই অভিযুক্তকে সাজা দিচ্ছেন। অনেকের স্বীকারোক্তি আদায় ছাড়াই দোষী সাব্যস্ত করছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখতিয়ারবহির্ভূত বিচারও করছেন।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোবাইল কোর্ট আইনের অনেক ধারা হাইকোর্ট সংবিধানপরিপন্থি ঘোষণা করেছেন। বিচারাধীন আপিলটি দ্রুত নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘নতুন নিয়োগ হওয়ায় আপিল বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা বেড়েছে। আশা করছি, শিগগির আপিলটির নিষ্পত্তি হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দু-একজন ম্যাজিস্ট্রেট যদি ভুল করেন, তাহলে তার কাজটা অবৈধ হবে। তবে ভুল করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে সতর্ক থাকতে হবে। যে কোনো কাজেই ভুল হতে পারে, ভুল হয়। মোবাইল কোর্টের বিচারেও ভুল হতে পারে। তবে তার ওপরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ (অ্যাপিলেট অথরিটি) আছেন। অ্যাপিলেট অথরিটি ভুল আদেশটি বাতিল করতে পারেন, স্থগিত করতে পারেন।’

‘মোবাইল কোর্ট আইনের অপব্যবহার’ রামগড় উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে বিজিবির জমি নিয়ে বিরোধ চলছিল। গত ১ আগস্ট সেই বিরোধপূর্ণ জায়গায় পুরোনো বেড়া সংস্কারের কাজে যান দিনমজুর আবুল কালাম ও রুহুল আমিন। পরে ইউএনওর (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার) নির্দেশে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা দুই দিনমজুরকে নিয়ে যান এই কর্তার কার্যালয়ে। ইউএনও খোন্দকার ইখতিয়ার উদ্দিন আরাফাত মোবাইল কোর্ট বসিয়ে দুই দিনমজুরকে পাঁচ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। তাদের কোনো বক্তব্য না শুনেই বেড়া ডিঙিয়ে সরকারি সম্পত্তি বেআইনি দখলের অভিযোগে জেলহাজতে পাঠান। পরে স্বীকারোক্তি আদায় ছাড়াই এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত না হয়েই সাজা দেওয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে হাইকোর্টে রিট করেন দুই দিনমজুর।

এই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২০ নভেম্বর রামগড় ইউএনওকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা থেকে বিরত রাখতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। জনপ্রশাসন সচিব ও খাগড়াছড়ির ডিসিকে এই নির্দেশ কার্যকর করতে বলা হয়। পাশাপাশি দুই দিনমজুরকে দেওয়া সাজা কেন অবৈধ হবে না ও তাদের ১০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে রুল জারি করেন। পরে ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন জানালে গত ৫ ডিসেম্বর চেম্বার আদালত হাইকোর্টের আদেশ বহাল রেখেছেন। একই সঙ্গে এ বিষয়টি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠিয়েছেন।

এরপর ৬ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (এসিল্যান্ড) মো. মামুন খানকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা থেকে ছয় মাস বিরত রাখতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার নিজরা গ্রামের বাসিন্দা লিটন মণ্ডলকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেন আদালত। রিটকারীর আইনজীবী জানান, লিটন মণ্ডল তার ড্রেজিং মেশিন দিয়ে স্থানীয়দের জমি ভরাটের কাজ করে আসছিলেন। গত ১০ সেপ্টেম্বর সদর উপজেলার এসিল্যান্ড মো. মামুন খান তার ড্রেজিং মেশিন জব্দ করে নিয়ে যান। পরে লিটন মণ্ডল এসিল্যান্ডের কার্যালয়ে গেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাকে ১ লাখ টাকা জরিমানার সাজা দেন। এ ছাড়া ড্রেজিং মেশিনের সঙ্গে জব্দ করে আনা পাইপগুলো ভেঙে ফেলা হয়। এরপর অফিসে ডেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ ও মামুন খানের অভিযান পরিচালনার ক্ষমতা স্থগিত চেয়ে রিট করা হয়।

রিট করা এই দুটি ঘটনা ছাড়া আরও অনেক ঘটনায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। গত ১৩ জুন দুপুর ১২টায় নাটোরের বঙ্গজল ট্রমা সেন্টারের সামনে থেকে সাকিব, আশিক ও আবিদকে গাঁজা সেবনের অভিযোগে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আটক করেন। পরে তাদের নেওয়া হয় অধিদপ্তরের অফিসে। দুপুরে তাদের আটক করা হলেও বিকেল ৩টার দিকে শহরের স্টেডিয়াম এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে হাজির করা হয় তাদের। এ সময় জোর করে সই নিয়ে ৩ জনকেই ১৫ দিন করে কারাদণ্ড দেন নাটোর সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রনি খাতুন। একই সময় অন্যান্য জায়গায় অভিযানে আটক হওয়া আরও ৩ জনকেও সাজা দেওয়া হয়। তবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক রনি খাতুন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘অপরাধ আমার সামনেই উদ্ঘাটিত হয়েছে এবং সংঘটিত হয়েছে।’ এদিকে শিশু আইনে শিশুদের বিচার একমাত্র শিশু আদালতে করার বিধান থাকলেও মাঝে মাঝেই মোবাইল কোর্টে দণ্ড দেওয়া হচ্ছে।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘দেশে আইনের শাসনের অভাব দেখা দিয়েছে। আইনের শাসন থাকলে তো জবাবদিহি থাকত; কিন্তু সেটা নেই। আইনের শাসনের দুর্বলতার কারণে মোবাইল কোর্টের অপব্যবহারও বেড়েছে। ভবিষ্যতে অপব্যবহার আরও বাড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার বিধান অবৈধ ঘোষণার বিরুদ্ধে করা আপিলের নিষ্পত্তি কোনোদিনই দ্রুত হবে না। কারণ, এটা দ্রুত নিষ্পত্তি করে সরকারের কোনো লাভ নেই। সরকারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মামলা ছাড়া অ্যাটর্নি অফিস কোনো মামলায় দ্রুত শুনানি করতে চায় না।’

Share