সাতক্ষীরার বসন্তপুর নৌবন্দরের চূড়ান্ত অনুমোদন

নয়াবার্তা সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের বসন্তপুর নৌ বন্দর চালু হতে আর কোনো বাধা রইল না। আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বসন্তপুর নৌবন্দরের জন্য চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে বলে আজ শুক্রবার নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে। এ নিয়ে সাতক্ষীরায় উচ্ছ্বাস আনন্দের পাশাপাশি চলছে মিষ্টি বিতরণ।

কালীগঞ্জের বসন্তপুর বন্দরটি সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ জনপদের মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নৌবন্দরটি কালীগঞ্জের ইছামতী, কালিন্দী ও (এককালের যমুনা) বর্তমানে কাঁকশিয়ালী নদীর ত্রিমোহনায় অবস্থিত। নদীর এপারে বাংলাদেশের মথুরেশপুর ও ভাড়াশিমলা ইউনিয়ন। ওপারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হিঙ্গলগঞ্জ থানা। বসন্তপুর গ্রামটি উপজেলা সদর থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এলাকাটি প্রাচীনকাল থেকে সব দিক দিয়ে সমৃদ্ধ।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজা প্রতাপাদিত্যের চাচাতো ভাই রাজা বসন্ত রায়ের নামানুসারে বসন্তপুর গ্রামের নামকরণ করা হয়। আঞ্চলিক গুরুত্ব বিবেচনায় পাকিস্তান সৃষ্টির শুরুর দিকে স্থানীয় জনগণের চাহিদা অনুসারে বন্দরটি তৎকালীন সরকার নির্মাণ করে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পর্যন্ত বন্দরটির সব কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। তখন এই বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি হতো বিভিন্ন প্রকার পোশাক, পিতল-কাসা, হাঁড়ি-পাতিল, ফলফলাদি, মুদিসামগ্রী, পেঁয়াজ, রসুন, মসলা ইত্যাদি। কাস্টম ও ইমিগ্রেশন বিভাগের কার্যক্রমও ছিল রমরমা। কিন্তু পাক-ভারত যুদ্ধের পর বন্দরের সব কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।

এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত দুই দেশের মানুষ এই নদীপথ দিয়ে চলাচল করত। স্বাধীনতার পর আর বন্দরটি চলেনি। স্থানীয়দের দাবি ছিল, ফের নৌবন্দরটি চালু করার। এটি চালু হলে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের প্রসার ঘটবে। চোরাচালান ও পাচার রোধ হবে এবং অবৈধ পণ্যের অনুপ্রবেশ বন্ধ হবে বলে তাঁদের দাবি।

স্থানীয়রা জানান, বসন্তপুর নৌবন্দর যদি পুনরায় চালু হয় তাহলে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। ইছামতী ও কালিন্দী নদী হয়ে সুদূর বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন মান্দারবাড়িয়া সি-বিচ, হেরোইন পয়েন্ট ও দুবলারচর দিয়ে ডায়মন্ডহারবার, পূর্ব-মেদেনীপুরের বন্দর এবং দীঘা সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটবে।

অন্যদিকে ভারতের অংশে টাকী, হাসনাবাদ, বসিরহাট হয়ে কলকাতা পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ ও সুলভ হবে। এ ছাড়া কাঁকশিয়ালী নদীকে ড্রেজিং করে প্রবহমান খোলপেটুয়া নদীর সঙ্গে সংযুক্ত করলে নৌপথে খুলনা অঞ্চলসহ রাজধানী পর্যন্ত অবাধ নৌবাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত হবে।

কালীগঞ্জের মথুরেশপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাকিম বলেন , ‘বসন্তপুরে পুনরায় বন্দর চালু হলে এলাকার মানুষের ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে।’

বসন্তপুর থেকে ভোমরা স্থলবন্দরটি ৪৮ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। বসন্তপুর নৌবন্দরটি পুনরায় চালু হলে ভারত ও বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বর্ণদ্বার উন্মোচিত হবে এবং সেই সঙ্গে পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটবে। এরই মধ্যে বসন্তপুর পোর্ট এলাকায় প্রশাসনের সহযোগিতায় রিভারড্রাইভ ইকোপার্ক নামের একটি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। যেখানে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ পর্যটকের সমাগম ঘটে।

কালীগঞ্জ, শ্যামনগর, আশাশুনি ও দেবহাটা উপজেলার অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসা, ভ্রমণ, বাণিজ্যসহ নানান কারণে ভারতে যাতায়াত করেন। নৌবন্দরটি পুনরায় চালু হলে দূরবর্তী ভোমরা স্থলবন্দরে না গিয়ে সহজেই বসন্তপুর নৌবন্দর ব্যবহার করতে পারবেন।

সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক এজাজ আহমেদ স্বপন জানান, ব্রিটিশ আমল থেকে বসন্তপুর নৌবন্দরটি একটি অন্যতম বন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পাকিস্তান আমলে এটি বন্ধ হয়ে যায়। সাতক্ষীরার ২৫ লাখ মানুষের প্রাণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই এলাকার গুরুত্ব বিবেচনায় স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়কে আধুনিক নৌবন্দর স্থাপনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির আহ্বায়ক বিআইডাব্লিউটিএর ঢাকার অতিরিক্ত পরিচালক সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের সমীক্ষা টিম গত ১৮ জুন সরেজমিনে কালীগঞ্জের বসন্তপুরে পরিদর্শনে আসেন। এ সময় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, স্থানীয় প্রশাসন, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তারা কথা বলেন।

বসন্তপুর নৌবন্দর বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমান বলেন, এক সময় এ অঞ্চলের মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল বসন্তপুর নৌবন্দর। এটি যদি পুনরায় চালু করা হয় তাহলে এ অঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াবে।

সাতক্ষীরা ৪ আসনের সংসদ সদস্য এস এম জগলুল হায়দার জানান, বসন্তপুর এলাকাটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের স্মৃতি বিজড়িত। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই এলাকা দিয়ে জাতির জনকের ছোট ভাই শহীদ শেখ আবু নাসের এবং বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ভারতে যাতায়াত করতেন। দক্ষিণাঞ্চলের অভিভাবক শেখ হেলালের হাত ধরে আজ বসন্তপুর নৌবন্দরটি পুনরায় চালু হতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই বন্দরের জন্য সুপারিশ করেছেন। সাতক্ষীরাবাসীর স্বপ্ন পূরণ করায় প্রধানমন্ত্রীকে সাতক্ষীরাবাসীর পক্ষ থেকে তিনি কৃতজ্ঞতা জানান ।

Share