হঠাৎ ‘কোটিপতি’ রেজাউলসহ আ.লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থী জামানত হারাচ্ছেন

বগুড়া প্রতিবেদক : বগুড়া-৭ (গাবতলী ও শাজাহানপুর) আসনের সংসদ সদস্য রেজাউল করিম ওরফে বাবলু ছিলেন একটি পত্রিকার সাংবাদিক। একসময় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি ১৭ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রথমবারের মতো স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। ওই নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় ভোটের এক দিন আগে রেজাউল বিএনপির সমর্থন পান। শেষ পর্যন্ত রেজাউল ট্রাক প্রতীক নিয়ে ১ লাখ ৯০ হাজার ২৯৯ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। এতেই যেন আলাদিনের জাদুর চেরাগ হাতে পান তিনি।

একাদশ নির্বাচনের আগে দেওয়া হলফনামায় রেজাউল করিমের নিজের ও নির্ভরশীলদের মাসিক আয় ছিল মাত্র ৪১৭ টাকা। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর সেই রেজাউল করিমই পাঁচ বছরে কোটিপতি ব্যবসায়ী বনে গেছেন। পাঁচ বছরে তাঁর স্ত্রীও হয়েছেন কোটিপতি। আলোচিত রেজাউল করিম এবার স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। ফলে হারাতে যাচ্ছেন জামানত।

এই আসনে মোট ভোটার ৫ লাখ ১২ হাজার ২৫৮ জন। ভোট পড়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫১টি। বাতিল ভোটের সংখ্যা ৪ হাজার ৪৪৪। এর মধ্যে ট্রাক প্রতীকে রেজাউল করিম ভোট পেয়েছেন ২ হাজার ৭টি। তাঁর প্রাপ্ত ভোট বাতিল ভোটের অর্ধেকের কম। নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তফা আলম ৯১ হাজার ২৯ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির প্রার্থী এ টি এম আমিনুল ইসলাম লাঙ্গল প্রতীকে পেয়েছেন ৬ হাজার ৮০১টি ভোট। নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী, মোট প্রাপ্ত ভোটের ৮ ভাগের ১ ভাগ ভোট যদি কোনো প্রার্থী না পান, সে ক্ষেত্রে তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।

সেই হিসাবে বিজয়ী প্রার্থী ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থী জামানত হারানোর তালিকায় আছেন। তাঁরা হলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল করিম (ট্রাক), এ টি এম আমিনুল ইসলাম (লাঙ্গল), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) আবদুর রাজ্জাক (মশাল), বাংলাদেশ কংগ্রেসের মেহেরুল আলম (ডাব), জেপির আবদুল মজিদ (বাইসাইকেল), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের এনামুল হক (ছড়ি), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ফজলুল হক (আম), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মো. রনি (নোঙর) ও বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার বাদল (ঈগল)।

পাঁচ বছরে অঢেল সম্পদের মালিক রেজাউল

একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পাঁচ বছর আগে রেজাউল করিম ও তাঁর নির্ভরশীলদের মাসিক আয় ছিল মাত্র ৪১৭ টাকা। বর্তমানে তাঁর নিজের ও নির্ভরশীলদের মাসিক আয় ৩ লাখ ২ হাজার ২৮ টাকা। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে তাঁর স্ত্রী বিউটি বেগমের এক টাকাও সঞ্চয় ছিল না। এখন বিউটি বেগম প্রায় সোয়া কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মালিক। পাঁচ বছর আগে রেজাউল করিমের কাছে নগদ অর্থ ছিল মাত্র ৩০ হাজার টাকা। এখন তাঁর হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। স্ত্রী বিউটি বেগমের কাছে আছে নগদ আড়াই লাখ টাকা।

পাঁচ বছর আগে রেজাউল করিমের বার্ষিক আয় ছিল পাঁচ হাজার টাকা। এখন তাঁর নিজের ও নির্ভরশীলদের বার্ষিক আয় ৩৬ লাখ ২৪ হাজার ৩৩৫ টাকা। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগে পুরোনো একটি মোটরসাইকেলে চড়তেন রেজাউল করিম। এখন বিলাসবহুল দুটি গাড়িতে চড়েন তিনি। একটি নিশান এক্সট্রেইল এসইউভি, অন্যটি ল্যান্ডক্রুজার। দুটি গাড়ির দাম ১ কোটি ৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। সংসদ সদস্য হওয়ার আগে কোনো ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট ছিল না রেজাউল করিমের। এখন রাজধানীর অভিজাত এলাকায় এক হাজার বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্টের মালিক তিনি। আছে সাড়ে ৪ শতাংশের অকৃষিজমি। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগে রেজাউল করিমের স্ত্রীর কোনো বাড়ি ছিল না। এখন ১ কোটি ১ লাখ টাকার একটি বাড়ির মালিক তিনি। আছে ১০ ভরি স্বর্ণালংকার।

পাঁচ বছর আগে রেজাউল করিমের আয়ের উৎস ছিল কৃষি ও ব্যবসা। এর মধ্যে কৃষি খাত থেকে বছরে আয় তিন হাজার টাকা। আর ব্যবসা থেকে বছরে দুই হাজার টাকা আয় ছিল তাঁর। ব্যাংকে ছিল মাত্র ৩০ হাজার টাকা। এখন বাসা ও দোকানভাড়া থেকে আয় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ব্যাংকের সঞ্চয়পত্র থেকে বার্ষিক আয় ৫ হাজার ১১০ টাকা। ব্যবসায় বিনিয়োগ আছে প্রায় সোয়া ১১ লাখ টাকা। ইট, বালু, সিমেন্ট ও অনলাইন ব্যবসা থেকে বছরে আয় ১১ লাখ ১৫ হাজার টাকা।

অবৈধ সম্পদের খোঁজে দুদক

সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর পাঁচ বছরে রেজাউল করিমের অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধানে নামে দুদক। পরে বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে ২০২১ সালের ১৪ মার্চের মধ্যে তাঁকে সম্পদের প্রাথমিক হিসাব দাখিল করতে বলা হয়। ওই বছর ২৩ জুন তিনি সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। বর্তমানে বিষয়টি দুদকের অনুসন্ধান নথিতেই আছে।

স্থানীয় ভোটাররা বলেন, পাঁচ বছর সংসদ সদস্য থাকলেও নির্বাচনী এলাকায় খুব একটা আসেননি রেজাউল করিম। উল্টো উন্নয়ন প্রকল্প কেনাবেচা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিও লেটার বাণিজ্য, পিস্তল হাতে তোলা ছবি ফেসবুকে দিয়ে ভাইরাল হওয়া, নারী স্বাধীনতার বিরোধিতা করে সংসদে বক্তব্য দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়াসহ নানা কারণে বিতর্কিত হয়েছেন। এতে নির্বাচনে তাঁর ভরাডুবি হয়েছে।

Share