অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নতির সম্ভাবনা দেখছে আইএমএফ

নয়াবার্ত‍া প্রতিবেদক : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশে চলমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে কিছুটা উন্নতির সম্ভাবনা দেখছে। সংস্থাটি মনে করছে, আগামীতে মূল্যস্ফীতির হার বর্তমানের তুলনায় কমবে। অন্যদিকে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে। তবে নিকট মেয়াদে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুরুদ্ধারে মুদ্রানীতির আরও সংকোচন করতে হবে। টাকার সঙ্গে ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় আরও নমনীয় হতে হবে। থাকতে হবে নিরপেক্ষ রাজস্বনীতি। অবশ্য অর্থনীতিতে উচ্চ অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি বজায় থাকবে বলে মন্তব্য করেছে আইএমএফ।

আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদের সভায় ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের অনুমোদনের পর গত মঙ্গলবার রাতে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ নিয়ে এমন মূল্যায়ন করেছে সংস্থাটি। বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ছাড়ের প্রস্তাবে অনুমোদন দেয় আইএমএফের পর্ষদ। আগামীকাল শুক্রবারের মধ্যে ছাড় হয়ে এ অর্থ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যুক্ত হবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার মতো।

আইএমএফ মনে করছে, চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ২ শতাংশে নামবে। বর্তমানে যা রয়েছে ৯ শতাংশের ওপরে। সংস্থাটির মতে, মুদ্রানীতির আরও সংকোচনের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতির প্রভাব জোরদার হবে। মুদ্রার একক বিনিময় হার গ্রহণের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে আইএমএফ ধাপে ধাপে আরও নমনীয় হওয়ার ওপর জোর দিয়েছে।

আইএমএফ জানিয়েছে, বেসরকারি খাতে চাহিদা কম থাকলেও তুলনামূলক ভালো রপ্তানির ওপর ভর করে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বাড়ানো এবং বিনিয়োগ জরুরি। করনীতি সংশোধন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে কর-রাজস্ব বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছে সংস্থাটি। ভর্তুকির যৌক্তিকীকরণ, ব্যয় করার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আরও দক্ষতার সঙ্গে আর্থিক ঝুঁকি মোকাবিলায় গুরুত্ব দিয়েছে তারা।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিষয়ে দাতা সংস্থাটির পর্যালোচনা হচ্ছে, চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়াবে ২৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ ১৯ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফ মনে করছে, বৈদেশিক লেনদেনের আর্থিক হিসাবে যে ঘাটতি আছে, তা অর্থবছর শেষে থাকবে না, বরং উদ্বৃত্ত থাকবে।

আইএমএফ মনে করে, আর্থিক খাতের সংস্কার জরুরি। ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি কমাতে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানোর পাশাপাশি মূলধন পুনরুদ্ধারে বিশেষ কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। আইএমএফের পরিচালকরা এ বিষয়ে একমত, ব্যাংক খাতের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো জোরদার, সুশাসন এবং পুঁজিবাজারের উন্নয়ন করা গেলে আর্থিক খাতের দক্ষতা বাড়বে এবং উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

আইএমএফ মনে করে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধে সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা উন্নত করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা ব্যবস্থা উন্নত হলে তা আর্থিক খাতের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বেসরকারি খাতের তহবিলও পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের অবস্থায় পৌঁছাতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের সুপারিশ করে আইএমএফ বলেছে, বাণিজ্যের উদারীকরণ, বিনিয়োগের পরিবেশ এবং সুশাসন নিশ্চিত করা, শ্রমশক্ত উন্নত করা এবং নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ বাড়ানো ও রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। যা আরও বিদেশি বিনিয়োগ আনতে এবং প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

আইএমএফের পরিচালকরা মনে করেন, কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও সংস্থাটির সঙ্গে নেওয়া কর্মসূচি পরিপালনে বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে পথচ্যুত হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশ যেসব সংশোধনমূলক ব্যবস্থা হাতে নিয়েছে ও সংস্কার বাস্তবায়নে জোর দিচ্ছে, তাকে স্বাগত জানিয়েছে সংস্থাটি।

আইএমএফের পরিচালকরা জানিয়েছেন, স্বল্পমেয়াদি নীতি প্রণয়নের লক্ষ্য হওয়া উচিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। এ জন্য পরিমাপভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে মুদ্রানীতি সংকোচন করতে হবে। রাজস্ব নীতি নিরপেক্ষ রাখতে হবে। বৈশ্বিক লেনদেনের ভারসাম্য পরিস্থিতির উন্নয়নে বিনিময় হারে আরও নমনীয় হতে হবে।

আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আন্তোয়েনেত সায়েহ এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুমুখী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। বৈশ্বিক একটি কঠিন চাপ বাংলাদেশে থাকার পরও ঋণ কর্মসূচির বাস্তবায়ন সঠিক পথে রয়েছে। ঋণ সহায়তাপুষ্ট কর্মসূচি সামষ্টিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহযোগিতা করছে এবং সুরক্ষা দিচ্ছে দুর্বল জনগোষ্ঠীকে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আইএমএফ গত জানুয়ারিতে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে। গত ফেব্রুয়ারির শুরুতেই প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার ছাড় হয়। সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে পুরো ঋণ পাওয়ার কথা রয়েছে। বর্ধিত ঋণ সহায়তা (ইসিএফ), বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) ও রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ)– এ তিনটি ভাগে ঋণ দিচ্ছে আইএমএফ। দ্বিতীয় কিস্তিতে ইসিএফ বা ইএফএফের আওতায় ৪৬ কোটি ৮৩ লাখ ডলার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলয় আরএসএফ তহবিল থেকে দিয়েছে ২২ কোটি ১৫ লাখ ডলার।

মতামত জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সরকারকে সঠিক ও কার্যকর নীতি পদক্ষেপ নিতে হবে। এখনই সম্ভব না হলেও নির্বাচনের পর অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংস্কার কার্যক্রম চালাতে হবে। আইএমএফ প্রস্তাবিত নিরপেক্ষ রাজস্ব নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজস্ব বাড়াতে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর বিষয়টিই উল্লেখ করা হয়েছে। অনেক সময় রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন খাতে করছাড় দেওয়া হয়। এগুলো পরিহার করতে বলা হয়েছে।

দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ শুক্রবারের মধ্যে আসবে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ায় সন্তু‌ষ্টি প্রকাশ করেছে‌ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী প‌রিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক সাংবাদিকদের জানান, দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার শুক্রবা‌রের ম‌ধ্যে দেশের রিজার্ভে যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া এডিবি থেকে ৪০ কোটি ডলার, দক্ষিণ কোরিয়ার একটি তহবিল থেকে ৯ কোটিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে ৬২ কো‌টি ডলার আস‌বে। সব মি‌লি‌য়ে এ মা‌সে রিজা‌র্ভে যোগ হ‌বে ১৩১ কো‌টি ডলার।

তিনি আরও বলেন, তাছাড়া চলতি মাসে রে‌মিট্যান্সসহ ডলার আসার প্রবাহ ইতিবাচক হওয়ার পাশাপাশি দাতা সংস্থার ঋণ বাড়ছে। একই সঙ্গে আগের তুলনায় ডলার খরচ কিছুটা হলেও কমেছে। তাই আগামীতে রিজার্ভ কমার কারণ নেই।

Share