‘আমাকে মেরেছেন, এটা আম্মাকে বইলেন না’, ইন্টার্নদের প্রতি রোগীর ছেলের আকুতি

রাজশাহী প্রতিবেদক : ‘আর মাইরেন না স্যার। ভাই, মাফ চাই। মাফ চাই ভাই। ম্যালা মাইর‍্যাছেন ভাই। আমাকে একটু পানি খেতে দেন। আমি মরে যাব। আমাকে মারার কথা আম্মাকে বইলেন না।’ মারের চোটে বারবার এ কথা বলছিলেন সুমন পারভেজ রিপন (২৮) নামের এক যুবক। এ সময় তাঁর কাছে স্বীকারোক্তি আদায় করা হলো যে রিপন ভুলই করেছেন। মারধরের ঘটনায় কোথাও অভিযোগ করবেন না, এমন স্বীকারোক্তিও নেওয়া হলো তাঁর।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক নারীর ছেলেকে দরজা বন্ধ করে এভাবেই বেধড়ক পিটিয়েছেন একদল ইন্টার্ন চিকিৎসক। আজ বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হাসপাতালের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কক্ষে এ ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী রিপনের বাড়ি রাজশাহী নগরীর বোসপাড়া মহল্লায়।

রিপনের মা পিয়ারা বেগম (৬০) গত শুক্রবার থেকে ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। দুই দফায় মারধরের সময় ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেন।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বুধবার বেলা ১১টার দিকে রিপন বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে ইন্টার্ন চিকিৎসকের কাছে তাঁর মায়ের চিকিৎসার খোঁজখবর নিতে যান। এই রিপোর্ট দেখার সময় ইন্টার্ন চিকিৎসকের সঙ্গে তাঁর কথা-কাটাকাটি হয়। পরে রিপন সেখান থেকে চলে গেলে কৌশলে ডেকে এক দফা মারধর করা হয়। এরপর একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক এলে রিপন তাঁকে ঘটনার বিষয়ে জানাতে যান। তখন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকের সামনেই দ্বিতীয় দফায় রিপনকে মারধর করা হয়। পরে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে নিয়ে যান। রিপনের বক্তব্য শোনার পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

দ্বিতীয় দফায় মারধরের ঘটনার ফাঁস হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, ভুক্তভোগী রিপন বলছেন, তাঁকে ডেকে এনে মারধর করা হয়েছে। তখন একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক রিপনকে শাসিয়ে বলেন, ‘কেন মারল সেই কথা বল।’ এ সময় একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক রিপনের টুপি খোলার নির্দেশ দেন এবং চড়থাপ্পড় মারতে শুরু করেন। তখন রিপন বলতে থাকেন, ‘ভাই, মাইরেন না আর।’ ‘ও মা’ ‘ও মা’ বলে চিৎকার করতে থাকেন তিনি।

একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘মারতে মারতে তোকে শেষ করে দিব। চিনিস তুই আমাদেরকে? চোখ-কান ফাটাবি তুই?’ রিপন বলতে থাকেন, ‘মাফ চাই ভাই, আর মাইরেন না ভাই।’ তখন একজন ইন্টার্ন বলেন, ‘এই ওর চুলডা খোলেন। ন্যাড়া করে দিই।’ তখন রিপন বলেন, ‘স্যার, আমাকে বাহির করে দেন স্যার।’

তখন ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘এই তুই বের হবি কেন? তুই না ডাক্তার দেখবি? দ্যাখ।’ রিপন বলতে থাকেন, ‘আমার আম্মু মইরে যাবে স্যার। এ রকম করিয়েন না।’ ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘তোর মা মরবে কি না, সেটা আমরা দেখব।’

এরপর আবার মারধর শুরু হয়। এ সময় একজন চিকিৎসক ‘থাক-থাক’ বলে থামানোর চেষ্টা করলেও মারধর চলতে থাকে। একজন বলে ওঠেন, ‘এই, তুই হাত দিতে চাইছিলি না? হাত কাইটা রাইখা দিই?’ রিপন বলেন, ‘আমি মারিনি কাউকে।’ তখন ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘এই তুই মারার চেয়ে বড় কিছু করেছিস।’

মারের চোটে একপর্যায়ে রিপন বলে ওঠেন, ‘আমি মরে যাব স্যার, একটু পানি দেন পানি।’ এ সময় জ্যেষ্ঠ চিকিৎসককে ডেকে একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘স্যার, আপনার পা দেন তো, এই তুই মাফ চা।’

রিপন আবার হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে থাকেন, ‘স্যার, একটু পানি দিবেন প্লিজ। ও আমার মাথা ঘুরছে।’ এ সময় একজন নার্স এসে পানি দেন।

তখন ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘মুখ ধো, পানি খাবি না।’ তখন আরেকজন ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘আমাকে বলেছে জুম্মায় জুম্মায় আট দিন বয়স হয়েছে। ওর চোখ, কান, মুখ আমি ফাটিয়ে দেব।’ তখন রিপন এ কথার প্রতিবাদ করে বলেন, ‘আমি এই কথা আপনাকে বলিনি স্যার।’

‘তুই আবার কথা বলিস? কাকে বলেছিস বল।’ জানতে চান ইন্টার্ন চিকিৎসক। এ সময় রিপন বলেন, ‘আমি কাউকে বলব না। আমাকে বের করে দেন স্যার।’

ইন্টার্ন চিকিৎসক তখন বলেন, ‘আমরা ভয় পাই নাকি তোকে? কাকে বলবি বল।’ রিপন বলেন, ‘আপনারা আমাকে ছেড়ে দেন। আমার আম্মা জানলে অসুস্থ হয়ে যাবে। আমার আম্মাকে বইলেন না প্লিজ। আমার আম্মাকে নিয়ে খুব টেনশনে আছি স্যার। আমাকে যে মেরেছেন, আমার আম্মাকে বইলেন না।’

একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘তোমার আম্মাকে বলব না। কিন্তু তোমার ব্যবস্থা করতে হবে।’ রিপন বলেন, ‘ব্যবস্থা তো করলেন স্যার।’ ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘করলাম তো। এখন ডিরেক্টর স্যারের কাছে নিয়ে যাব।’

রিপন বলেন, ‘নিয়ে চলেন। কিন্তু আম্মাকে বুঝতে দিয়েন না স্যার।’ এ পর্যায়ে রিপনকে ‘পানি খাও’ বলে পানি খেতে দেওয়া হয়।

তখনো মারধর শুরু হলে রিপন আবার বলতে থাকেন, ‘আর মাইরেন না স্যার। হাতজোড় করছি স্যার। অনেক মেরেছেন।’ এ সময় রিপনের নাম-ঠিকানা জানতে চাওয়া হয়। এ সময় রিপনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি এটা নিয়ে কখনোই কোনো কথা বলব না। কোনো অভিযোগ করব না।’

পরে হাসপাতালে দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যরা গিয়ে রিপনকে উদ্ধার করে হাসপাতাল পরিচালকের কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে রিপন তাঁর সারা শরীরে মারধরের দগদগে চিহ্ন দেখান।

এদিকে রিপনকে হাসপাতালে এমন নির্মমভাবে নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছেন অনেকে। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠেছে।

রামেক হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদে নানা সময় কর্মসূচি পালন করা সামাজিক সংগঠন রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ‘হাসপাতালে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কিছু সামনে আসে, বেশির ভাগই আসে না। হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা যাওয়ার প্রতিবাদ করায় তাঁর ছেলেকে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করার ঘটনাও ঘটেছে। নতুন এই ঘটনা যাঁরা ঘটিয়েছেন, আমরা অবিলম্বে তাঁদের গ্রেপ্তার চাই। তা না হলে রাজশাহীর মানুষকে সাথে নিয়ে আমরা মাঠে নামব।’

এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলী বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে শেখার জন্য পাঠানো হয়েছে। ডাক্তারি করার তাঁদের লাইসেন্সও আছে। এমন ঘটনা তাঁরা ঘটালে লাইসেন্সও বাতিল হতে পারে। যদিও আসলে কী ঘটেছে, তা আমি জানি না।’

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এফ এম শামীম আহমদ বলেন, ‘এই ছেলে ডাক্তারদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছিল। ডাক্তাররা তার বিরুদ্ধে আমার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছে। ছেলেটাকেও আমার কাছে আনা হয়েছিল। মৌখিকভাবে সে জানিয়েছে যে তাকেও ইন্টার্নরা মারধর করেছেন। আমি তাকে লিখিত অভিযোগ দিতে বলেছি। এ পর্যন্ত সেটা পাইনি।’

পরিচালক জানান, রিপন লিখিত অভিযোগ না দিলেও তিনি একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি করে দেবেন। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সঙ্গে যে সুপারিশ আসবে, সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন।

হাসপাতালে থাকা অবস্থায় রিপন এই মারধরের ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি।

নগরীর রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল হক বলেন, ‘হাসপাতালে একটা ঘটনা ঘটেছে বলে শুনেছি। কিন্তু আমার কাছে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। এটা হাসপাতালের ব্যাপার। তারপরেও কোনো অভিযোগ পেলে তদন্ত করে দেখা হবে।’

Share